নৃত্যশিল্পী থেকে মিশেল ইয়ো যেভাবে ‘অ্যাকশনের রানি’ হলেন
মালয়েশিয়ার অভিনেত্রী মিশেল ইয়োকে বলা হয় ‘অ্যাকশন কুইন’। বয়স ৬০ পেরিয়েছে। এখনো ধুন্ধুমার মারামারিতে তাঁর বিকল্প খোঁজা কঠিন। গত মে মাসে হার্ভার্ড ল স্কুলের সমাবর্তনে দারুণ এক বক্তৃতা দিয়েছেন অস্কারজয়ী এই অভিনেত্রী। বলেছেন নিজের জীবনের গল্প। দিয়েছেন পরামর্শও। পড়ুন নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।
আমি আইনজীবী নই। এমনকি কখনো আইনজীবী চরিত্রে অভিনয়ও করিনি। আমাকে কেন তোমাদের সমাবর্তনে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলো, কে জানে! তবে আজ নিজের জীবন থেকে তোমাদের তিনটি পরামর্শ দেব। বলব—পতন থেকে কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়।
প্রথম পরামর্শ: নমনীয় থাকো
অভিনয় নয়, আমার প্রথম প্রেম ছিল নাচ। খুব ছোটবেলায় বুঝতে পেরেছিলাম, শারীরিক কসরতের মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের একটা গুণ আমার আছে। দিন-রাত চর্চা করে নিজেকে তৈরি করছিলাম। নানা দ্বিধা যখন কানের কাছে ফিসফিস করত, তখন নাচেই আমি নিরাপদ বোধ করতাম। ধরেই নিয়েছিলাম, নাচই আমার ভবিষ্যৎ। তাই ইংল্যান্ডের একটা ব্যালে স্কুলে ভর্তি হয়ে শুরু হয় আমার স্বপ্নে বাঁচা। কিন্তু জীবন আমার জন্য অন্য পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিল। মেরুদণ্ডে একটা ইনজুরি হলো। ব্যস, সব স্বপ্ন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল জীবনটাই শেষ।
কৃতিত্ব দিতে হয় আমার সেই ব্যালে স্কুলের প্রিন্সিপালকে। তিনিই বলেছিলেন, ভবিষ্যতের ব্যাপারে নমনীয় থাকো। পড়ে গেলে আমরা সাধারণত ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে শরীর শক্ত করে ফেলি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে শান্ত থাকা, কৌতূহল নিয়ে চারপাশটা দেখাই সবচেয়ে নিরাপদ।
ক্রিয়েটিভ আর্টে ডিগ্রি নেওয়া শেষে আরও উন্মুক্ত মন নিয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম। এমন সব বিকল্প নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম, যা কখনো মাথায় নিইনি। সেই সুবাদেই হংকংয়ে একটা বিজ্ঞাপনে কাজের সুযোগ এল। আর এভাবেই শুরু হলো আমার অভিনয়জীবন।
দ্বিতীয় পরামর্শ: নিজের সীমাবদ্ধতা জানো
তুমি কী পারো, সেটা যেমন জানা জরুরি, তেমনি তুমি কী পারো না, তা-ও জানা দরকার। ভেতরে-বাইরে—দুই ধরনের সীমাবদ্ধতা তোমাকে মোকাবিলা করতে হবে। ভেতরে-ভেতরে যদি সীমাবদ্ধতাগুলো জানো, তাহলে আরও বিনয়ী হবে, লক্ষ্যের প্রতি নত হবে। বাইরে থেকে সমাজও তোমার ওপর কিছু সীমাবদ্ধতা চাপিয়ে দেবে। সেগুলো পাত্তাই দিয়ো না।
একজন তরুণ অভিনেত্রী হিসেবে হংকংয়ের অভিনয়ের দুনিয়ায় পা রাখতে গিয়ে প্রতি পদে পদে আমাকে সীমাবদ্ধতা পেরোতে হয়েছে। শুরুর দিকে সব চিরায়ত চরিত্রই পেয়েছি—নম্র, ভদ্র, আদুরে নারী। খুব দ্রুতই বুঝতে পারি, আমি তো আসলে এগুলো করতে চাই না। আমি হতে চাই ‘হিরো’। করতে চাই অ্যাকশন। কিন্তু অ্যাকশন শুধু পুরুষদের জন্যই বরাদ্দ ছিল।
নাচের প্রশিক্ষণের আত্মবিশ্বাস থেকে বুঝতে পারছিলাম, আমি অ্যাকশনেও খুব ভালো করতে পারব, যদি সুযোগটা পাই। প্রযোজককে গিয়ে অনুরোধ করলাম। ছেলেরা যা করে, সব করতে প্রস্তুত ছিলাম। এবং এ-ও বুঝতে পারছিলাম, প্রথম সুযোগে নিজেকে প্রমাণ করতে না পারলেই সব শেষ। আর সুযোগ পাব না। সৌভাগ্যক্রমে সব ভালোয় ভালোয় হলো। দর্শকও ইয়েস ম্যাডাম–এর মতো একটা নারীপ্রধান অ্যাকশন-কমেডি গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল। একসময় জেট লি আর জ্যাকি চ্যানের সঙ্গে আমার নামও যোগ হলো—যে তিনজন মানুষকে হংকংয়ের কোনো বিমা প্রতিষ্ঠান গ্রাহক করতে রাজি হয়নি। এই প্রত্যাখ্যানকেও আমি অবশ্য অনন্য সম্মান হিসেবে নিয়েছি।
কদিন পর আবিষ্কার করলাম, নিয়মিত ছাদ থেকে ছাদে লাফিয়ে বেড়াচ্ছি, চলন্ত ট্রেনের ওপর মোটরসাইকেল চালাচ্ছি, চলমান গাড়ি থেকে আরেক গাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ছি। অবশ্যই ইনজুরি হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি আঘাত, হাড়ের ফাটল, আঁচড়, দাগের পর আমি আরও সাহসী হয়েছি। পড়ে গিয়ে মানুষ দাঁড়াতে শেখে। আর দাঁড়ালে মানুষ আরও উঁচুতে লাফ দিতে শেখে। তাই তো জেমস বন্ডের প্রযোজক যখন টুমরো নেভার ডাইজ ছবির প্রস্তাব নিয়ে আমার দরজায় হাজির হলো, ধরেই নিয়েছিলাম তাঁরা নিশ্চয়ই জেমস বন্ড চরিত্রে আমাকে ভাবছে। (হাসি)
সীমাবদ্ধতাগুলো আদতে আমাদের চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। আর চ্যালেঞ্জ আমাদের আরও সামনে এগোতে, নিজেকে আরও তাগাদা দিতে অনুপ্রাণিত করে। যতবার আমাকে অবমাননাকর কোনো চরিত্রের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যতবার আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছি, যতবার কেউ আমাকে ছোট চোখে দেখেছে, আমি আরও ভালো করার প্রেরণা পেয়েছি।
তৃতীয় পরামর্শ: নিজের লোকদের খুঁজে নাও
সব জয়ীর বিপরীত দিকেই যে একজন পরাজিতও থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বেশির ভাগ সাফল্যের গল্পই প্রতিযোগিতার নয়, সহযোগিতার। আজ পর্যন্ত যা করেছি, কিছুই কিন্তু আমার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার আশপাশে যে মানুষগুলো আমাকে সহায়তা করেছে, বিশ্বাস রেখেছে, তাঁদের জন্যই এত অর্জন। কখনো কখনো যতটা না নিজের জন্য, তার চেয়ে বেশি তাদের জন্য আমি হার মানতে চাইনি।
পরিবর্তন করতে হলে সমানুভূতি থাকতে হয়। অন্যের চোখে দেখলেই আমরা সহানুভূতিশীল হতে শিখি, যা আমাদের সত্যিকার দুনিয়ায় ‘অ্যাকশনে’ যেতে সাহায্য করে। সহানুভূতিই হলো সত্যিকার সুপার পাওয়ার। (সংক্ষেপিত)