বাইরে অপেক্ষমাণ শত শত সাংবাদিক, তাঁদের মাঝে নিজেকে খুঁজছি
প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’ সম্পাদনা করেছেন এক দশকেরও বেশি সময়। তারপর মাথায় চাপল সিনেমার ভূত। কয়েকটা একক আর ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য লিখে আর দু-একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য পরিচালনা করে হাত মকশো করলেন, তারপর যুক্তরাজ্য ও কানাডায় চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা ও হাতেকলমে কাজ শিখলেন। ২০২০-২১ সালে সরকারি অনুদান পেল তাঁর চিত্রনাট্য বলী। ২৮তম বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের নিউ কারেন্টস বিভাগে সেরা হয়েছে সেই সিনেমা। সাংবাদিক থেকে নির্মাতা হওয়ার যাত্রাটা কেমন ছিল? সে গল্পই বলছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
ফরাসি অভিনেত্রী মারিয়োঁ কোতিয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে বেদনাতুর চাহনি। সে চাহনির মানে একটাই—তুমি এত খারাপ কেন!
মারিয়োঁর সেই বেদনাতুর চাহনিকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছি না। আমি সাংবাদিকতা করি। তারকাদের বেদনা নিয়ে ভাবার সময় আমার কম। আমি প্রশ্নের মারপ্যাঁচে হলিউড তারকা ব্র্যাড পিটের সঙ্গে তাঁর চলমান সম্পর্কের গুজব নিয়ে অধিকতর জানতে আগ্রহী। মারিয়োঁ হয়তো আগেই এসব নিয়ে বেকায়দায় ছিলেন। এখন লাইভ অনুষ্ঠানে এই সম্পর্ক নিয়ে আমার এমন প্যাঁচানো প্রশ্ন তাঁকে নিশ্চিত আহত করেছিল। মারিয়োঁ কষ্ট পেয়েছিলেন। সম্ভবত আতঙ্কিতও হয়েছিলেন। আমি বুঝিনি। আমি খুশি ছিলাম, কারণ মারিয়োঁ কোতিয়ার মতো বড় অভিনেত্রীকে আমি প্রশ্নের জালে আটকে ফেলতে পেরেছি। ২০১৫ কি ২০১৬ সালের কথা। ঘটনাস্থল কান চলচ্চিত্র উৎসবের সংবাদ সম্মেলন কক্ষ। ফেড আউট।
ফেড ইন। বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে বলী (দ্য রেসলার)-এর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার। আমার হাতে মাইক্রোফোন। আমি স্রেফ বোকা হয়ে তাকিয়ে আছি এক কোরীয় তরুণ প্রশ্নকর্তার দিকে। তিনি প্রশ্ন করেছেন—বলী খেলার সঙ্গে আমার সিনেমার চরিত্রগুলোর সম্পর্ক কী?
সহজ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই কেন যেন সব গুবলেট করে ফেললাম। সঞ্চালক পার্ক সুন ইয়াং আমাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করলেন। লাভ হলো না। উত্তর খুঁজতে খাবি খাচ্ছি। আসলে ভেতরে-ভেতরে চিন্তা করছি, এ কি মারিয়োঁ কোতিয়ার অভিশাপ! না হলে এত সহজ প্রশ্নে এমন আটকে যাব কেন?
বুসান সিনেমা সেন্টারের প্রেক্ষাগৃহে একটা সিটও খালি নেই। বলী দেখতে এসেছেন শত শত মানুষ। আমার আপ্লুত হওয়ার কথা। কিন্তু আমার মাথায় মহা দুশ্চিন্তা। কারণ, সিনেমা শেষেই প্রশ্নোত্তর পর্ব। আমি জানি, একটা-দুটো প্রশ্ন আসবেই একদম আচমকা, গুগলি অথবা ইয়র্কার হয়ে। আমাকে বোকা বানিয়ে স্টাম্প এলোমেলো করে দেবে। ঘটেছেও তা–ই। সাংবাদিক হিসেবে আমার পূর্বাভিজ্ঞতা এখানে কোনো কাজে লেগেছে? মনে হয় না। আমার প্রযোজক পিপলু আর খান মঞ্চে না থাকলে এই প্রশ্নোত্তর পর্বের ফাঁড়া আমি কীভাবে পার হতাম জানি না।
সাংবাদিক থেকে নির্মাতা। বিষয়টা খুব খারাপ নয়। এক কোরীয় সাংবাদিক আমার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বুসানে। বলী নিয়ে তাঁর প্রতিটি প্রশ্ন চমকে দেওয়ার মতো। (এত গবেষণা করে কীভাবে সাক্ষাৎকার নিতে আসে মানুষ!) উনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, সাংবাদিকতা থেকে সিনেমায় আসার সুবিধা কী? আমি বলেছি, দুটো জিনিস আসলে খুব কাছাকাছি। সিনেমায় আমরা গল্প বলি। অবাস্তব গল্পকে বাস্তবতার মোড়ক দিই। প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’র ফিচারেও আমরা গল্প বলতাম। সত্য ঘটনা। গল্পের মতো করে। দুটো জিনিস খুব কাছাকাছি। উদ্দেশ্যও শেষতক কাছাকাছি। আলগোছে মানুষের হৃদয় ছোঁয়ার চেষ্টা। আমি খুব ছোটবেলায় লেখক হতে চেয়েছিলাম। কোনো কিছু না বুঝেই ভেবেছিলাম গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মতো সাংবাদিক থেকে লেখক হব। নোবেল পুরস্কার জিতব (কী হাস্যকর!)। সেই স্বপ্ন বহু আগেই ভেস্তে গেছে। সব স্বপ্ন পূরণ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আবার স্বপ্ন মাঝেমধ্যে হালনাগাদ করাতেও কি ক্ষতি?
২০১৪ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সাংবাদিক হিসেবে অংশ নিয়েছিলাম। প্রথম আলো সম্পাদক কীভাবে আমাকে অফিসের খরচে যেতে দিয়েছিলেন, ভাবলে অবাক লাগে! সম্পাদক যেতে দিয়েছেন। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক গোপনে উৎসাহ দিয়েছেন। আমি তো যাবই কানে। আর একবার যখন কানে পৌঁছে গেছি—মারি তো গন্ডার, পড়ি তো প্রথম আলো! আনিসুল হকের দেওয়া অপ্রকাশিত স্লোগান। ভালো কিছু করার চেষ্টা তো আমাকে করতেই হবে। মনে মনে ভেবেছিলাম, কোনো হলিউড অভিনয়শিল্পীর এক কিলোমিটারের মাঝে যেতে পারলেও সেটা নিয়ে লম্বা ফিচার ফেঁদে ফেলব। বিমানভাড়া তো উশুল করতে হবে। তাই না?
কিন্তু এত ভাবনার কারণ ছিল না। কানে গিয়ে প্রথম দিনেই কপাল খুলে গেল। কীভাবে কীভাবে নিকোল কিডম্যানের ভিডিও করে ফেললাম। মহা উত্তেজিত হয়ে ঢাকায় পল্লব মোহাইমেন ভাইকে ফোন করলাম। উত্তেজনা সব সময় সংক্রামক। একদিন এই ভিডিও করতে গিয়েই ঐশ্বরিয়ার গাউনে পা মাড়িয়ে ফেলেছিলাম। কী বিতিকিচ্ছি কারবার! ইনারিতুর পিছু ধাওয়া করেছিলাম বাথরুম অবধি। প্রশ্নবাণে আটকে দিয়েছিলাম রোমান পোলানস্কিকে। স্পিলবার্গ, টারান্টিনো আমার প্রশ্ন শুনে বেদম হেসেছিলেন। উৎসাহব্যঞ্জক হাসি। আহা! উত্তেজনাভরা সেসব দিন! লোকে বলে, কান ইজ আ গেম। আমি ছিলাম সেই বিশ্ব আসরে এক বাংলাদেশি খেলোয়াড়। খেলেছি ২০১৪-১৮ পর্যন্ত। তারপর ইস্তফা। উৎসবের লালগালিচাগামী বিশেষ গাড়িবহর আমার খুব প্রিয় ছিল। দেখামাত্র সনি হ্যান্ডিক্যাম নিয়ে ওসব গাড়ির পিছু ধাওয়া করতাম। কোনো দিন ভাবিনি, একদিন এসব গাড়ির ভেতর বসব।
কদিন আগের কথা। বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনী দিন। বলী উৎসবের সবচেয়ে বড় পুরস্কার জিতে নিয়েছে। আমি আর অভিনেতা নাসির উদ্দিন খান ভাই উৎসবের সেই বিশেষ কালো গাড়িতে লালগালিচায় যাচ্ছি। না তাকিয়েই বুঝতে পারছি নাসির ভাইয়ের চোখে পানি। আহারে! এই মানুষটারও দেখি আমার মতো অশ্রুগ্রন্থির সমস্যা। গাড়ি লালগালিচার দিকে এগোচ্ছে। বাইরে অপেক্ষমাণ শত শত সাংবাদিক, সিনেমাপ্রেমী, আলোকচিত্রী। আমি জানালা দিয়ে দেখছি বাইরে। ভিড়ের মাঝে খুঁজছি আমাকে।