বাবা আমার ছায়ানটের সুর
যদি বলি, আমার কাছে আমার বাবা যেন ঠিক ‘রাগ ছায়ানট’, তখন অনেকেই হয়তো খানিক ভ্রু কুঁচকে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন; ভাববেন, এর আবার মানে কী! বাবাকে নিয়ে বিশ্বময় নানা জনে নানা আন্তরিক স্তুতি, শংসা কিংবা মহিমা–কীর্তন করেছেন, রচিত হয়েছে নানান হার্দিক বন্দনা। কিন্তু স্নেহশীল কিন্তু দায়িত্ববান, ঋজু অথচ মমতাময় ‘বাবা’র সঙ্গে স্বর আর সুরের ব্যাকরণে বাঁধা শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগকে মেলানোর ভাবনা খানিক অসংগতিপূর্ণ মনে হতেই পারে।
‘বাবা’ শব্দটার মধ্যে পরম স্নেহময় ভালোবাসা আর আদরের উষ্ণতা যেমন আছে, ঠিক তেমন করেই এর মধ্যে আছে গভীর আস্থা, ভরসা, বিশ্বস্ততা আর নির্ভরতার আশ্বাস। আর ঠিক এই কারণেই পরিণত বয়সে এসে ছায়ানট রাগের সুর আর স্বরের বোধের সঙ্গে বাবাকে নিয়ে আমার ভাবনা যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে একে অপরকে জড়িয়ে রয়েছে। একেবারেই আমার বাবার মতোই শান্ত–ধীর প্রকৃতির রাগ ছায়ানট তাই আমার একান্ত নিজের প্রিয় অনুষঙ্গ। সেই অনুষঙ্গে বেদনার নীল রং আছে, আছে ভালোবাসাময় উদ্যাপন, আছে বিচ্ছেদের হাহাকার, আবার একই সঙ্গে আছে পুনর্মিলনের একান্ত গভীর প্রতীক্ষা।
‘গানের ভেতর দিয়ে’ ভুবন দেখা এই আমি রাগ ছায়ানটের স্বর–সংগতিতে বাবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই আমি আমার ভাবনায়, আমার হৃদয়ে—সেখানে বাবার মেয়ে আমি আর গানের মানুষ আমি একাকার হয়ে যায় অবলীলায়। এই রাগের চলনে–বলনে–গায়নে, এর সুরের ভাঁজে আমি আমার বাবার জীবনবোধ, তাঁর জীবন দর্শনের দেখা পাই। ছায়ানট রাগে বাঁধা নানা গানের পরতে পরতে তাঁর মন, মনন আর বোধকে অনুভব করি একান্ত নিজের মতো করে। তাই এই পৃথিবীতে বাবার কায়িক অনুপস্থিতিতেও প্রতিদিন রাগ ছায়ানটের স্বরসংগতি আর সুরের গাঁথুনিতে আমি বাবার আশ্রয় খুঁজে পাই। ছায়ানটের সুর ‘ধূসর আকাশ হইবে সুনীল তোর চোখের চাওয়ায়’ বলে নিয়ত আমাকে জানান দিয়ে যায়—আমার বাবা তো সদাসর্বদা আমার সঙ্গেই আছেন। পার্থিব এই জগতে তাঁর অনুপস্থিতি কেবল যাপনের স্থানান্তর, অন্য ভুবনে আবাসন কেবল।
শাস্ত্রীয় সংগীতের পণ্ডিতেরা বলেন ‘ছায়া’ আর ‘নট’—এই দুই প্রাচীন রাগের সম্মিলনেই ছায়ানট রাগের বর্তমানের স্বরূপের উদ্ভব ঘটেছে। ‘ছায়া’ রাগের সংযত আর পরিমিত রূপে প্রাবল্য আছে; কিন্তু বাহুল্য নেই আর ‘নট’ রাগের চলনে আছে শান্ত সৌম্য এক গভীরতা। আর এই দুইয়ের সম্মিলনে যে ছায়ানট রাগ, তার আবহ রাত্রির মেঘমুক্ত আকাশের উজ্জ্বল তারকাখচিত মহাবিশ্বের মতো উন্মুক্ত। এ যেন ঠিক আমার বাবা, যার উদার সংস্কারমুক্ত আধুনিক মন আর উদাত্ত হৃদয় একেবারেই যেন এক মেঘমুক্ত আকাশ। আর তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা আর মননের গভীরতা সেই হৃদয়–আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই জীবনবোধের দিশা দেখাত আমাদের, তাঁর চারপাশের সকলকে সতত। তাঁর চরিত্রেও ছিল স্বভাবসিদ্ধ পরিমিতি আর গভীর বৌদ্ধিক জ্ঞানতৃষ্ণার সহাবস্থান। কাজে, কথায়, যাপিত জীবনাচরণে সদা সংযত বাবার ছিল প্রবল অনুসন্ধিৎসু মন যা সর্বক্ষণ জানতে চাইত, বোধে আনতে চাইত বিজ্ঞান থেকে সাহিত্য, পুরাণ থেকে প্রযুক্তি, রাজনীতি থেকে সংগীত। তাঁর এই প্রয়াসে জ্ঞানতৃষ্ণার প্রাবল্য ছিল; কিন্তু দেখানেপনার নামমাত্র বাহুল্যও ছিল না। ছায়ানট রাগ যেমন চিত্তাকর্ষক তার সুরের মিষ্টতা, স্বরসংগতির পেলবতায় আর সমর্পণের গভীরতায়; তেমনি আমার বাবার ব্যক্তিত্বের সরল সততা, মনের স্বচ্ছতা আর জ্ঞানের গভীরতাও সবাইকে মোহিত করেছে, মুগ্ধ করেছে আজীবন। এখন আমার এই পরিণত বয়সে এসে খুব করে বুঝতে পারি, বাবার যাপিত জীবনাচরণ আর দর্শন যেন সত্যিকার অর্থেই ছায়ানট রাগের রূপে, চলনে, গায়নে প্রকৃষ্টভাবে প্রকাশমান হয়, যেখানে সুরের গভীরতা আছে; কিন্তু কোনো কিছুর আতিশয্য নেই, অপ্রয়োজনীয় অনাবশ্যকতা নেই একেবারেই। তাই ছায়ানটের সুর বারবার আমাকে জানান দেয়, বাবা আছেন তাঁর সবটুকু নিয়ে আমার সমগ্র অস্তিত্বকে ঘিরে। আর তাই এই রাগের সুর আর স্বরসংগতি আমাকে নিয়ত প্রাণিত করে বাবার মূল্যবোধ আর জীবনদর্শনকে নিজের যাপিত জীবনের চর্চা আর চর্যায় নিতে। তাই সত্যিই খুব গভীরভাবে আমার মনে হয় যেন অনন্তলোক থেকে বাবা ছায়ানট রাগের চলনে, গায়নে আর সুরে তাঁর জীবনবোধের শিক্ষা পাঠান প্রতিনিয়ত আর খুব বেশি করে বুঝিয়ে দিয়ে যান আমাকে ‘কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’।
বাবার কাছ থেকে পাওয়া বোধ, বৌদ্ধিক চিন্তা আর মননের কথা যখন এলই, তখন এই উপলব্ধিও ভীষণ প্রবলতর হলো এই ভেবে যে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধান মোতাবেক ‘বাবা’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত আলোচনায় আক্ষরিক অর্থেই আমি আমার বাবাকে খুঁজে পাই। সংস্কৃত ‘বপ্র’ অর্থাৎ যে বীজ নিষেক বা বপন করে থেকেই বাংলায় ‘বাপ’ শব্দের আগমন আর আমার ‘বাপ’ (বাবা) সত্যিকার অর্থেই আমার মধ্যে জীবনদর্শন, মূল্যবোধ, সৃজনশীলতার বীজ বপন করে দিয়েছেন সেই শৈশবে, এমনকি বুঝে ওঠারও আগে। সেই বোধ আর মননে দেশপ্রেম আছে, ইতিহাস-রাজনীতি-চিরায়ত দর্শন চিন্তা আছে, সাহিত্য-সংগীতপ্রীতি আছে, আছে জানার-দেখার-বোঝার প্রবল ইচ্ছা; আর আছে মানুষের প্রতি অগাধ প্রতীতি। সেই কোন শৈশবেই বাবা মনে আর মাথায় গভীরভাবে গেঁথে দিয়েছিলেন ‘মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর’। আর তাই তো সচেতনে এমনকি অচেতনেও সুরাসুরের দ্বন্দ্ব থেকে সতত ‘অসুর’কে পাশ কাটিয়ে বা বর্জন করে ‘সুর’কে খুঁজে নেওয়ার নিরন্তর প্রয়াসকেই জীবনের চর্চা বলে জানতে আর মানতে শিখেছি। মনে আছে খুব ছোটবেলায় স্কুলের পাঠ্যবইয়ে সংস্কৃতি-ঐতিহ্য এসবের সংজ্ঞা আর তার সহজ ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা ছিল, তার কিছুই এখন আর তেমন করে মনে নেই; কিন্তু খুব ভালো করে মনে আছে, আজীবন বিজ্ঞানের ছাত্র আমার বাবা কী অদ্ভুত সহজভাবে বুঝিয়েছিলেন যে ‘সংস্কৃতি’ প্রকৃতপক্ষে এক উন্নততর জীবনবোধ, জীবনাচরণের অভিলাষ। আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে এই যে আরও সুন্দর করে চারপাশের সবাইকে নিয়ে বাঁচার যে তাড়না; আর সেই তাড়না থেকে নিজেকে খোঁজার আর জানার যে পরম স্পৃহা—তাই আসলে ‘সংস্কৃতি’র মূল কথা। জীবন সম্পর্কে, কখনোবা যাপিত জীবন থেকে চাওয়া-পাওয়ার হিসাবকে নিয়ে, কখনো আবার এর থেকে উত্তরণের যাচনার প্রয়াসকে ঘিরে সাধারণ মানুষের নিবিড় উপলব্ধিই এর সারবস্তু; আর তাই একটি জাতির সংস্কৃতিকে বুঝতে গেলে, উপলব্ধি করতে গেলে সেই জনপদের মানুষের জীবন সম্পর্কে চেতনা, বোধ আর তাদের দৈনন্দিন জীবনের যাপন আর উদ্যাপনের মর্মমূলে দেখতে হবে। বাবাই গল্পচ্ছলে বুঝতে শিখিয়েছিলেন সংস্কৃতি কেবল মাত্র জ্ঞান, নাচ, কবিতা, গল্প বা কিছু আচার–রীতির সন্নিবেশ নয়; যাপিত জীবনের নানান উপচার, অভ্যাস, রীতি–রেওয়াজের সঙ্গে সংস্কৃতির আরেক অনিবার্য তথা অপরিহার্য উপাত্ত হলো মূল্যবোধ। আর কত গভীরভাবেই না জীবনাচরণের খুঁটিনাটি অভ্যাসে বা যাপিত জীবনের নানা কিছুর মধ্য দিয়ে আমাদের হৃদয়ে এই বিশ্বাস বাবা জনমের মতো করে গেঁথে দিয়ে গেছেন যে কেবল মূল্যবোধের সংযুক্তিতেই সংস্কৃতি যে কোনো মানুষকে সুন্দরভাবে বাঁচতে শেখায়, আত্মানুসন্ধানের পথ দেখায়, সূক্ষ্ম জীবনের সুলুক সন্ধান দেয়। আর এই প্রয়াস জীবনযাপনের অভ্যাস হলে নিজের সংস্কৃতিকে আরও বেশি করে হৃদয়ে ধারণ করে মনে–প্রাণে বৈশ্বিক হয়ে ওঠা সম্ভব। পরে বড় হয়ে বাবার কথা মেনেই পড়তে গিয়ে দেখি, মোতাহের হোসেন চৌধুরীও ‘সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা’, ‘প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা’, ‘বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা’–কেই সংস্কৃতি বলছেন। আর উন্নততর জীবনবোধের খোঁজ যদি থেকে থাকে সংস্কৃতির মর্মমূলে, তাহলে তার জন্য আত্মানুসন্ধানে নামতেই হবে। নিজে জানতেন, বুঝতেন আর খুব করে মানতেন বলে বাবা তাঁর সন্তানদেরও বোঝাতে আন্তরিক চেষ্টা করেছেন যে আবহমান সংস্কৃতিভাবনার গোড়ায় রয়েছে সেই নিজেকে জানার, নিজেকে খুঁজে বেড়ানোর এক অদম্য গভীর বাসনা। তাঁর এই নিজেকে জানার, খুঁজে বেড়ানোর নিরন্তর প্রয়াসকেই আমি খুঁজে পাই ছায়ানট রাগের ‘মধ্যম’ স্বরের কেন্দ্রিকতায়, যা প্রকাশিত হয় ‘পা মা রে’-এই স্বর সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে। আর ছায়ানট রাগে পঞ্চম আর ঋষভ স্বরসংগতি ভারী তাৎপর্যপূর্ণ আর সেই স্বরসংগতি এই রাগের রূপের পরম প্রকাশ ঘটায়। বাবার ভাবনা মোতাবেক ‘সংস্কৃতি’কে যদি ‘পঞ্চম’ স্বর ভাবি, তবে আরেক অনিবার্য তথা অপরিহার্য উপাত্ত ‘মূল্যবোধ’ হয় ‘ঋষভ’ আর তাদের এই চিরন্তন সংগতিতেই আমার কাছে আমার বাবা চির মূর্তমান হয়ে রয়ে যান।
আমাদের বাড়িতে নিজেদের কিংবা কোনো পূর্বজ-পূর্বপুরুষ অর্থাৎ পিতামহ, মাতামহ এমন কারও ছবি বাঁধাই করে দেয়ালে ঝুলতে দেখিনি কস্মিনকালেও; বরং আজন্ম দেখেছি দেয়ালে বিরাট ফ্রেমে বাঁধানো রবিঠাকুর আর বঙ্গবন্ধুর ছবি। বাবা আন্তরিকভাবে জানতেন আর বিশ্বাস করতেন রবিঠাকুরের কল্পনাতে যে বাংলা নামের সোনার দেশ ছিল, সেই কল্পনাকে মূর্তময় বাস্তবতায় পরিণতি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাবার সেই ভাবনার, সেই গভীর বিশ্বাসের প্রতিফলন ছিল তাঁর কথায়, তাঁর কাজে। এমনকি তাঁর সন্তানদের মধ্যেও সেই ভাবনা মনের গভীরে প্রোথিত করতে পেরেছেন তিনি সফলভাবেই। বাংলাদেশ, বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, চিরায়ত দর্শন বাবা ধারণ করতেন তাঁর অন্তরে, যা প্রকাশ পেত তাঁর যাপিত জীবনের আচারে, রুচিতে, বোধে, কথায় ও কাজে। সেই কোন শৈশবে ঠিকমতো বোধ তৈরি হওয়ারও আগে আমাদের হাতে নিজের দেশকে বোঝার, জানার, দেখার যে দুটি প্রাথমিক উপচার-উপকরণ তুলে দিয়েছিলেন, তা ছিল রবিঠাকুর আর বঙ্গবন্ধু। বাবার সঙ্গে সাদামাটা কথায় বা তাঁর খুঁজে, বেছে দেওয়া বইয়ের পাতায় অথবা তাঁর সঙ্গে গভীর আলোচনা-পর্যালোচনায় এই দুজনকে চিনতে বা জানতে গিয়ে বাংলাদেশকে আর দেশের মানুষকে জানতে বা বুঝতে চেয়েছি, নাকি বাঙালিকে আর বাঙালির বাংলাদেশকে বুঝতে গিয়ে রবিঠাকুর আর বঙ্গবন্ধুকে বোঝার আজন্ম প্রয়াসে নেমেছি, তা বলা ভারী মুশকিল। বাবার মেয়ে বলেই আমার মন আর মননে যে বাংলাদেশ বিরাজ করে, সেখানে রবিঠাকুরের স্বপ্ন-কল্পনা আর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস-চেতনা একাকার হয়ে গেছে। তাই আমার মানসচক্ষে বাংলাদেশকে আমি খুঁজে পাই রবিঠাকুরের চোখে, বঙ্গবন্ধুর তর্জনীতে। বাংলাদেশকে নিয়ে বরাবর বাবার ভারি গর্ব ছিল, স্বপ্ন ছিল, ছিল একবুক আশা। এই জনপদের মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। নিজের ‘বাঙালি’ আত্মপরিচয়ে ছিল ঐকান্তিক অহংবোধ আর সগৌরব পুলক; কিন্তু সেই অহংবোধে গভীরতা ছিল নিঃসন্দেহে; কিন্তু একেবারেই ছিল না কোনো লোকদেখানো আড়ম্বর; কিংবা উদ্দেশ্যমূলক প্রাবল্য। বাবার এহেন গভীর আন্তরিক বিশ্বাস আর সচেতন অহংবোধের ভাবনাও আমাকে বারবার করে রাগ ছায়ানটে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই রাগ ছায়ানটের অন্তর্নিহিত ভাব হলো গভীর ভক্তির। এই রাগের সুর আর স্বরসংগতিতে হার্দিক আত্মসমর্পণের রূপ প্রকাশ পায়। এর আন্দোলিত ধৈবত তার আন্দোলনের একমুখী যাত্রায় ধাবিত হয় কোমল নিষাদের দিকে আর তাতেই এই রাগে প্রকাশ পায় সমর্পণের সুরে পরম ভক্তি আর নিবেদন। আমার বাবাও ঠিক তেমনি ছায়ানটের সেই ধৈবতের মতোই রবিঠাকুর আর বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’কে তাঁর ‘কোমল নিষাদ’ জেনে আর মেনে সমর্পিত ছিলেন আজীবন তাঁর কথায় আর কাজে। তাই বাংলাদেশকে ভাবলে, কিংবা নিত্যকার বাঙালিয়ানার যাপনে, উদ্যাপনে আমি ছায়ানটের সুরে বাবার ছায়া খুঁজে পাই।
বাবা যেমন ভীষণ রকম বাঙালি ছিলেন, তেমনি তিনি যুগের থেকেও অনেক অগ্রবর্তী বৈশ্বিক মানুষ ছিলেন। রবিঠাকুরের কথা উদ্ধৃত করে সব সময় বলতেন ‘মানুষকে মানুষ বলে দেখতে না পারার মতো সর্বনেশে অন্ধতা আর নেই।’ এখন এই পরিণত বয়সে এসে খুব করে বুঝি যে বাবা আজীবন নিরন্তর নিজের মধ্যে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, রূপান্তর, উত্তরণের প্রয়াস সচল রেখেছিলেন। সেই প্রয়াসে শিকড়ের সন্ধানের সঙ্গে সমান্তরালভাবে ছিল বিশ্বজনীন নানান ভাবনা আর জীবনদর্শন থেকে আহরণ করবার নিগূঢ় ইচ্ছা। তাই কখনো বিশ্বজনীনতার দর্পণেও নিজের শিকড়কে খুঁজেছেন, তাকে বিশদে বোঝার ও জানার পথ খুঁজেছেন। এতে বাবার মননে আমি আজীবন নানাবিধ, বহুমাত্রিক মানবিক ভাবনার নানান চিন্তাধারা সমন্বয় দেখেছি। আর এই জন্যই বাবার ভেতরে দারুণ এক অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেছিল, যা ছিল একই সঙ্গে বাঙালির চিরায়ত দর্শনের মর্মমূলের কথা; আবার দারুণ রকম বৈশ্বিক। বাবার এই বিশ্বজন হয়ে আরও বেশি করে বাঙালি হয়ে ওঠার মধ্যেও আমি ছায়ানট রাগ খুঁজে পাই। এই রাগে ‘রে গা মা পা’ বলে সোজা ‘ধা’ তে না গিয়ে বরং ‘রে গা মা নি ধা পা’ স্বরসংগতি ব্যবহৃত হয়। মধ্যম থেকে নিখাদ হয়ে ধৈবতে আসার ফলে এই রাগের সুরের গভীরতা যেমন বাড়ে, তেমনি এর মিষ্টতাও বাড়ে; এর করুণ রস প্রবল হয়। বাবার এই নানান সংস্কৃতি, নানান ঐতিহ্য, নানান মত-পথ-মতবাদ দর্শন পড়ে, জেনে–বুঝে আরও বেশি করে বাঙালির শিকড় খুঁজে পাওয়ার মধ্যে আমি ছায়ানটের মধ্যম থেকে পঞ্চম হয়ে ধৈবতে না গিয়ে বরং মধ্যম থেকে নিখাদ হয়ে ধৈবতে আসার যে পদ্ধতি বা প্রণালি, তার সমাপতন দেখি। আর নিজের ভেতরকার শিকড়ের সুলুকসন্ধান প্রয়াসে বিশ্বজনীন হয়ে উঠবার অভিলাষকে মেলাতে পারায় বাবা আজীবন অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের চর্চা আর চর্যা করতে পেরেছেনই কেবল নয়, তাঁর সন্তানদেরও শিখিয়েছেন। আর বাবার ভেতরকার ছায়ানটের গভীর সুর দিয়েই তিনি ধর্ম–বর্ণ–গোত্র ও জাতপাত–নির্বিশেষে সব মানুষকে ‘মানুষ’ ভাবতে পেরেছেন। তাঁর যাপিত জীবনের একেবারে ভিত্তিমূলে রয়েছে এই সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক মানস আর মনন, তাতে ছায়ানটের মতো ভক্তিরস আছে, আছে গভীর সমর্পণের সুর; কিন্তু তাতে নেই আনুষ্ঠানিকতার আড়ম্বর কিংবা পোশাকি তকমা।
বিজ্ঞানের ছাত্র, কৃষিবিজ্ঞানী আমার বাবা তাঁর কিশোর বয়স থেকেই ভীষণভাবে সাহিত্য আর সংগীতে আশ্রয় খুঁজেছেন। আর দিনে দিনে তা আরও গভীরতর হয়েছে। যেমনটি বলছিলাম, নিজের বাঙালি আত্মপরিচয়ে দারুণভাবে গর্বিত বাবা আমার, তাঁর প্রতিদিনের আটপৌরে জীবনযাপনের অভ্যাসকে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, গানের চর্চা দিয়ে সাজিয়ে উদ্যাপন করে তুলেছিলেন। গ্রামের শিকড়হীন পুরোদস্তুর শহুরে এই মানুষ বাংলার গ্রাম, জনপদ, জনপদের মানুষসহ সমগ্র বাংলাদেশকে প্রাণে ধারণ করার উৎসমুখে ছিল বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান—যা বরাবর ছিল বাবার আনন্দের অমৃতধারা, শোকের সান্ত্বনা, প্রেরণার উৎস। আমার বিশ্বাস, অমন বাবা পেয়েছিলাম বলেই হয়তো প্রকৃত অর্থেই ‘গানের ভেতর দিয়ে ভুবনখানি’ দেখতে শিখেছি। গানে গানে, গানের সুরের আবেশে ও বাণীর বারতায় বাঙালির বাঙালিত্বকে অনুভব করার শিক্ষাও পেয়েছি বাবার কাছেই। তিনি গানের মানুষ ছিলেন না, গাইতেন না, গাইতে জানতেন না; কিন্তু গান নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন, ভাবতে ভালোবাসতেন। আর গান নিয়ে যে ভাবা যায়, ভাবতে হয়, তাঁর শিক্ষাও পেয়েছি বাবার কাছেই মনের অজান্তেই সেই কোন ছোটবেলায়। আমার ‘অগায়ক’ ‘অশিল্পী’ বাবা কত না গল্প করতেন আর বোঝাতেন, কেমন করে গানের বাণীকে প্রাণে ধারণ করতে হয়। আর তাই হয়তো এখন দেখি কী সহজতায় আর সহজাতভাবে আমার বাঙালিয়ানার স্বরূপে গান-গানের সুর-সুরের বোধ পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। খুব ভাগ্য করে এমন মা–বাবা পেয়েছিলাম, যাঁরা গানকে জীবনে জুড়ে দিয়েছেন স্কুলে যাওয়ারও আগে। সুরের মধ্যে নিজেকে খোঁজা, নিজের শিকড়কে খোঁজার এই যে অন্তহীন অসীম আনন্দময় যাত্রা বোঝার জ্ঞান হওয়ারও আগে সেই কোন শৈশবে শুরু করেছিলাম, এখন এই পরিণত বয়সে এসেও সেই যাত্রা নিরবচ্ছিন্ন ধারায় সচল আছে আমার অস্তিত্বের সহজাত অভ্যাস হয়ে। আর বাবা খুব করে মনে আর মাথায় গেঁথে দিয়েছিলেন গান কেবল গাইবার নয়, সে অনুভবেরও। সেই কোন শৈশব থেকে বছরের পর বছর বাবার সঙ্গে গান শিখতে যাওয়ার পথে কাটানো অযুত মুহূর্তগুলো আজ আমার কাছে অমূল্য। আজ পেছনে ফিরে চাই আর নতুন করে বাবাকে খুঁজে পাই। বাংলা থেকে বিশ্বসাহিত্য, পুরাণ থেকে ইতিহাস, ভাষা থেকে সংস্কৃতি কত কিছুর সঙ্গে গানের ভাবনাকে মেলাতে শিখিয়ে গেছেন আমার অগোচরেই। আমাদের সেই বাবা-মেয়ের এই আলাপচারিতা চলেছে তাঁর চলে যাওয়ার দিন কতক আগে অবধি। কোনো ভৌগোলিক দূরত্বও কোনো দিন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে, আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার কয়েক দিন আগেও বাবার কর্কটরোগক্লিষ্ট মলিন মুখখানা সেই বিকেলেও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল গানকে ঘিরে আমাদের আলোচনায়। বাবার খুব প্রিয় রাগ ছিল ছায়ানট। কিশোরবেলায় রেওয়াজে বসে এই রাগ গাইতে শুরু করলেই বাবা হয় এসে আমার কাছে বসতেন, নয় তো বদ্ধ ঘরে না ঢুকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ শুনে যেতেন। থামলে হয়তো বলতেন ‘আবার একটু করবে নাকি মা ওই বন্দিশটা?’ সেই কিশোরবেলাতে দীপালি নাগের কাছে ছায়ানটে বাঁধা আগ্রা ঘরানার বন্দিশ আর তার থেকে নজরুলের ভাঙা গান শিখে বাবাকে শোনার পর তাঁর সেই তৃপ্ত মুখখানা আজও মনে ভাসে। আর ভাবি হয়তো এই ছোট ছোট আনন্দই বাবাকে দেওয়া আমার শ্রেয়তর উপহার। বই ছাড়া আর কোনো জাগতিক জিনিসে কখনোই তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না। ছায়ানটে বাঁধা নজরুলের ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়’ গানটাও তাঁর ভারী প্রিয় ছিল আমার কণ্ঠে। বাবা অনন্তলোকে যাওয়ার আগে শেষ যে কটি গান শুনতে চেয়েছিলেন, এটি তার মধ্যে একটি। তাই কোনো ব্যাকরণের নিয়ম মেনে নয়; বরং এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা অযুত স্মৃতির কারণে আমার ছায়ানটের সুর আর আমার বাবা যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে একে অপরকে জড়িয়ে আছে। আমার একান্ত নিজস্ব ভাবনায় ছায়ানটের সুরে আর স্বরসংগতিতে বাবাকে খুঁজে পাই বলেই হয়তো বাবাহীন এই পৃথিবীতে তাঁর উপস্থিতি টের পাই গভীরভাবে। সেই বাবা আমার ‘চিরবন্ধু, চিরনির্ভর’ হয়ে ছায়ানটের আলাপে, বিস্তারে, তানে চির বিরাজমান।
ড. নিরুপমা রহমান: শিক্ষক, কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া