হুমায়ুন কবীরের আরেক উদ্ভাবন বিমানের মতো হেলিকপ্টার
২৭ বছর ধরে বোয়িংয়ে কাজ করছেন হুমায়ুন কবীর। মার্কিন উড়োজাহাজ কোম্পানিটির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এসে জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী ঘুরে গেলেন বাংলাদেশি এই অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার। তখন তাঁর জীবনের গল্প শুনেছেন সুমন মোল্লা
কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউসের একটি কক্ষে বসে ছিলেন হুমায়ুন কবীর। পাশে তাঁর স্ত্রী ফরিদা কবীর। প্রায় দুই দশক পর দেশে এসেছেন। ঢাকায় নেমেই ছুটে আসেন কটিয়াদীর নাগেরগ্রামে। আত্মীয়স্বজন আর গ্রামবাসীর সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন, নিয়েছেন তাঁদের দেওয়া সংবর্ধনা। সমবেতদের শুনিয়েছেন ছেলেবেলা, পড়াশোনা আর বিজ্ঞানী হওয়ার নানা গল্প। সেই সূত্র ধরেই আমাদের আলাপ শুরু হলো। তাঁর কাছে জানতে চাই, নাগেরগ্রামের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কীভাবে বোয়িংয়ে পৌঁছালেন, হলেন শীর্ষস্থানীয় বিমান প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ডায়নামিকস ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড এসএমই (সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্ট)।
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন হুমায়ুন কবীর
তখন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়েন হুমায়ুন কবীর। প্রতিদিন মেঠোপথ ধরে স্কুলে যান। যেতে যেতে দেখেন সমবয়সীরা ফসলের মাঠে কাজ করছেন, কেউ গরুর পাল নিয়ে ছুটছেন, দু-একজন আবার খালের পানিতে দাপাদাপি করছেন। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই তাঁকে টানে না। তাঁর মন পড়ে থাকে পাখির পাখায়। হঠাৎ হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ তুলে উড়ে যায় বিমান, হেলিকপ্টার। বিমান দেখলেই তাঁর মধ্যে ভর করে অদ্ভুত এক চাঞ্চল্য। কোনো কোনো দিন বিমানের পেছন পেছন দৌড়ও দেন। এভাবেই শুরু। ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে পাখির মতো বিমানের উড়ে চলার রহস্য জানার আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর এক ভাইয়ের কাছ থেকে প্রথম জানতে পারেন এত ওজন নিয়েও কীভাবে আকাশে ভেসে থাকে বিমান। অ্যারোস্পেস শব্দটির সঙ্গেও এ সময় প্রথম পরিচয়। পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারলে নাকি এই বিষয়ে লেখাপড়া করা যায়।
স্বপ্ন ছুঁতে পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হয়ে ওঠেন হুমায়ুন কবীর। প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে থাকেন। ফলও পান। ১৯৬৫ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের মধ্যে আবাসিক বৃত্তিতে প্রথম হন। এটাই ছিল বিজ্ঞানী হওয়ার পথে হুমায়ুন কবীরের প্রথম পদক্ষেপ, নাগেরগ্রাম থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত যাত্রাপথের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় হুমায়ুন কবীরের মাকে ছেড়ে চলে যান বাবা। পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হুমায়ুনও বাড়ি ছাড়েন। লজিং থেকে বনগ্রাম আনন্দ কিশোর উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। এই সময় গণিতের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন হুমায়ুন কবীর। কারণ, তিনি জেনেছিলেন অ্যারোস্পেস নিয়ে পড়তে হলে ভালো গণিত জানা প্রয়োজন।
১৯৭১ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কিশোর হুমায়ুনও তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটে কৃতিত্বপূর্ণ রেজাল্ট করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হন। উড়োজাহাজের উদ্ভাবক রাইট ভাইদের দেশ যুক্তরাষ্ট্র সব সময় হুমায়ুনকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। তাঁর মনে হয়েছে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই এ বিষয়ে খোঁজ নিতে থাকেন। নিয়মিত যেতেন ইউসিস লাইব্রেরিতে। সেই সূত্রেই ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের সঙ্গে যোগাযোগ।
রাইট ভাইদের দেশে
১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ না চুকিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের পথে পাড়ি জমান হুমায়ুন। ভর্তি হন আরলিংটনের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে। অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএস করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে মাস্টার্সও করেন। তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল এয়ারপ্লেন অ্যারোডাইনামিকস। ১৯৮৪ সালে মাস্টার্সে পড়ার সময়ই ব্রান্টলি-হাইনস হেলিকপ্টার ইন্ডাস্ট্রিজের একটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। মার্কিন সেনাবাহিনীর মিসাইল কমান্ডের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত সেই প্রকল্পের নাম ছিল ‘টেস্ট অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন অব রোটারি-উইয়িং টার্গেট’। পাঁচ আসনের বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার ব্র্যান্টলি ৩০৫ বা হাইনস এইচ-৫-কে দূরনিয়ন্ত্রিত হেলিকপ্টারে রূপান্তরিত করেন তাঁরা। ১৯৮৬ সালে আকাশে ওড়ে চালকবিহীন হেলিকপ্টার। এই প্রকল্পে হুমায়ুনের সহ–উদ্ভাবক ছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীর জন জে অ্যাপোকা।
১৯৮৭ সালে ভক্সওয়াগন আমেরিকায় রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন হুমায়ুন কবীর। এখানে ছিলেন ১৯৮৯ পর্যন্ত। এরপর পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে হেলিকপ্টার অ্যারোডাইনামিকসে আবার মাস্টার্স করতে জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হন। মাস্টার্স শেষে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এট অস্টিন থেকে ডক্টরেট করেন হুমায়ুন কবীর। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মহাশূন্যযান এবং রকেটবিজ্ঞান। এরপর টেক্সাস স্টেট বোর্ড অব রেজিস্ট্রেশন থেকে রেজিস্টার্ড প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ারের স্বীকৃতি পান ড. হুমায়ুন কবীর। পিএইচডি শেষে ১৯৯৪ সালে ডায়নামিকস অ্যান্ড অ্যারোডাইনামিকস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অ্যাগস্টা অ্যারোস্পেস করপোরেশনে কাজ করেছেন। ১৯৯৭ সালে ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন বোয়িংয়ে। এখনো এই প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত আছেন।
বোয়িংয়ে হুমায়ুন কবীরের কর্মজীবন যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ। হেলিকপ্টারের অনেক আধুনিক আবিষ্কারের পেছনে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। দ্য বেল বোয়িং ভি-২২ অসপ্রি, বোয়িং সিএইচ-৪৭ চিনুক, অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড এডব্লিউ১০১ ও এ১০৯সি মডেলের হেলিকপ্টার উদ্ভাবনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন হুমায়ুন কবীর।
বোয়িংয়ে হুমায়ুন কবীরের নতুন একটি উদ্ভাবন এখন বাণিজ্যিক ব্যবহারের অপেক্ষায় আছে। এই হেলিকপ্টার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি। এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। এই উদ্ভাবনের বিশেষত্ব কী জানতে চাইলে বললেন, এটি অবতরণ করবে হেলিকপ্টারের মতো, কিন্তু উড়বে বিমানের মতো। আকাশে দীর্ঘক্ষণ স্থির হয়ে থাকতে পারবে। অবতরণে বিমানবন্দরের প্রয়োজন হবে না। আমেরিকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনার কাজেই মূলত হেলিকপ্টারটি ব্যবহার করা হবে। একজন পাইলট, একজন কো–পাইলট ও একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে এটি পরিচালনা করা সম্ভব। ধারণা করা হচ্ছে, দুর্গম স্থানে জরুরি ত্রাণ পৌঁছে দিতে নতুন যুগের সূচনা করবে এই হেলিকপ্টার।
হুমায়ুনের অতৃপ্তি
দেশে না এলেও আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগটা হুমায়ুন কবীরের বরাবরই অটুট আছে। বাংলাদেশের হালহকিকতও তাঁর জানা। তবু এবার দেশে এসে অনেক পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন। বিশেষ করে যোগাযোগব্যবস্থা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রসারের কথা বারবার বলছিলেন। অপরিকল্পিত উঁচু উঁচু ভবন আর সরু সরু সড়ক তাঁকে ভাবনাতেও ফেলেছে। কৃষির বাইরে আরও কিছু নতুন খাত গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখায় স্বস্তির কথা জানালেন হুমায়ুন কবীর।
দেশকে নিয়ে কিছু ভাবছেন কি না, জানতে চাইলে কিছুটা আক্ষেপই প্রকাশ করলেন হুমায়ুন কবীর। জানালেন, তিনি যা জানেন বাংলাদেশে তাঁর প্রয়োগ ঘটানোর সুযোগ এখনো কম আর তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহও কম। তবে তিনি যা জানেন, প্রয়োজন বোধ করলে তা জানাতে চান। পাশ থেকে হুমায়ুন কবীরের স্ত্রী ফরিদা কবীর বলে উঠলেন, ‘আমার স্বামীর প্রতিটি অর্জনের পেছনে পারিবারিক অনেক ত্যাগ আছে। তারপরও প্রতিটি অর্জনে আমরা তৃপ্ত হই। দেশকে তৃপ্ত করতে পারলে তা পূর্ণতা পেত।’