চিঠিগুলোতে আছে যুদ্ধদিনের আঁচ, থমকে যাওয়া ডাকব্যবস্থার চিত্র
চিঠিগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধের দলিল। প্রতিটি চিঠিতে আছে যুদ্ধদিনের আঁচ, থমকে যাওয়া ডাকব্যবস্থার চিত্র। নিজের সংগ্রহের কিছু চিঠি নিয়ে লিখেছেন ডাকসংগ্রাহক ও গবেষক এ জেড এম আখলাকুর রহমান
১২ জুন ১৯৭১। দ্য ইস্ট পাকিস্তান কো-অপারেটিভ ইনস্যুরেন্স সোসাইটি লিমিটেড থেকে সিলেটের জামালগঞ্জ (বর্তমানে সুনামগঞ্জ জেলার অংশ) থানার ভিম কালী ডাকঘরে পাঠানো হয় একটি চিঠি। ১৪ জুন চিঠিটি সিলেটে পৌঁছায়। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এক মাসের বেশি সময় রেখে দিয়েও চিঠিটি জামালগঞ্জে পাঠানো সম্ভব হয়নি। তাই ২৫ জুলাই চিঠিটি ঢাকা জিপিওতে ফেরত পাঠানো হয়। এই চিঠিতে ফেরত পাঠানোর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘সার্ভিস নট অ্যাভেইলঅ্যাবল’।
মুক্তিযুদ্ধের কারণে ডাকযোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে, এই কথা সরাসরি তখন লেখা সম্ভব ছিল না। তবুও এলাকা বিশেষে ডাকব্যবস্থার স্থবিরতা নির্দেশ করে এই চিঠি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে যার শুরু। হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পর স্তব্ধ হয়ে পড়ে জনজীবন। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঢাকা থেকে অন্যান্য শহর আর শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে যেতে থাকে লোকজন। অনেক মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় ভারতে। পাশাপাশি পাকিস্তান সেনাবাহিনীও সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে পরের দুই মাস চিঠিপত্রের আদান-প্রদান সেভাবে পরিলক্ষিত হয় না। মে নাগাদ পরিস্থিতি কিছুটা থিতু হওয়ার পরে লোকজন আবার প্রিয়জনের খোঁজখবর নিতে শুরু করে। জুন ও জুলাই থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হলেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা একদম থেমে যায়নি, ফলে ডাকযোগাযোগও থেমে ছিল না।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। আস্তে আস্তে শত্রুমুক্ত হতে থাকে বিভিন্ন এলাকা। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ সময়টা জনজীবন কার্যত স্তব্ধ ছিল। ২০ ডিসেম্বর ডাক বিভাগ পুনরায় কার্যক্রম শুরু করে। ফলে এই ১৮ দিন বাংলাদেশে ডাকব্যবস্থা বন্ধ ছিল বলেই ধরে নেওয়া যায়।
যুদ্ধদিনের খণ্ডচিত্র
জরুরি অবস্থায় প্রায় সব চিঠিই সেন্সর করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর ১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধের সময় প্রাপ্ত চিঠিতে সেন্সর সিল দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় চিঠির খামে এ রকম সিল বিরল। তবে সেন্সর যে হতো, নিদেন খুলে পড়া যে হতো, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। যদি সেন্সর না–ও করা হয়, সেন্সর হতে পারে, এই আশঙ্কায় খুব খোলামেলাভাবে কেউ চিঠি লিখত না। তবুও চিঠির ভাষায়, কথার মাঝে, যুদ্ধদিনের খণ্ড খণ্ড চিত্র উঠে এসেছে।
৩০ আগস্ট ১৯৭১। আইডিয়াল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে একটি চিঠি সম্ভবত তাদের কোনো গ্রাহককে পাঠানো হয়েছিল। খামটি উইন্ডো টাইপের, অস্পষ্ট সিলের কারণে প্রাপকের অবস্থান জানা যায় না। প্রাপককে না পাওয়ায় চিঠিটি আইডিয়াল লাইফে ফেরত আসে। প্রাপককে না পাওয়ার কারণ হিসেবে ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ডাকপিয়ন লিখেছেন, ‘লেফট, অ্যাড্রেস হেজ গন টু ইন্ডিয়া (চলে গেছেন, প্রাপক ভারত চলে গেছেন)।’ সম্ভবত, বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি শরণার্থীর একজন ছিলেন এই চিঠির প্রাপক।
একইভাবে মে ও জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের পাঠানো দুটি চিঠি চট্টগ্রামের দুটি ভিন্ন ঠিকানা থেকে ফেরত আসে। উভয় ক্ষেত্রেই প্রাপককে না পাওয়ার কারণ হিসেবে লেখা আছে ‘লেফট’, প্রাপক যদি হয় অমুসলিম, তাহলে ১৯৭১ সালে এই একটি শব্দও অনেক অর্থ বহন করে।
যশোরের প্রতাপকালী থেকে ১৯৭১ সালের ১১ আগস্ট ইব্রাহীম হোসেন নামের এক ব্যক্তি বিমা কোম্পানিতে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠির ওপরের দিকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ লিখেছেন আর ভেতরে লিখেছেন, ‘… কিন্তু দুঃখের বিষয়, হেড মাস্টার শ্রী প্রবোধ কুমার মিত্র, গুলির আঘাতে নিহত হয়েছেন। পলিসিটার টাকা জমা দেওয়ার সময় হইলে তিনার কাছেই দিতাম। টাকা জমা দেওয়ার রশিদ তিনার কাছে থাকিত। তিনি মারা যাওয়ার পর অন্য সবাই ইন্ডিয়ায় চলে গেছে।’
একাত্তরের কিশোরী
৩০ নভেম্বর ১৯৭১। একটা পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে স্বাধীনতাযুদ্ধ। প্রশিক্ষণ নিয়ে দলে দলে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। সাধারণ মানুষ মনের মধ্যে অজানা আশঙ্কা নিয়ে দিন পার করছেন।
সে সময় রাজশাহীতে প্রায় বন্দী জীবন যাপন করছে বুলা। তার বান্ধবী খুলনার শিরীনকে একটা চিঠিতে সে লিখেছে, ‘…আমরা এখানে ভীষণ অসুবিধায় আছি। কোথাও বেড়ানো যায় না, সারা দিন ঘরে অসহ্য ঠেকছে। কত দিন যে এভাবে যাবে? আমার বোন এখনো ঢাকায় যায় নাই, যা অবস্থা সেখানকার।’
সাধারণত চিঠি থাকে মুখবন্ধ খামে। তাই এর কথাগুলো জানতে পারে যে চিঠিটার প্রাপক শুধু সেই। কিন্তু যুদ্ধকালে সাধারণ নিয়ম খাটে না। তখন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মতো সব চিঠিও সেন্সর করা হয়। কোনো কথা বা শব্দে আপত্তি থাকলে সেটা কেটে দেয় সেন্সর কর্তৃপক্ষ, এই চিঠির অসিলায় জিজ্ঞাসাবাদ, গ্রেপ্তার, এমনকি হত্যাও যদি করা হয়, কে কার হয়ে সেই ঘটনার জবাবদিহি চাইবে? তাই সে সময় চিঠি লিখতে হতো অনেক সতর্কতার সঙ্গে, প্রতিটা শব্দ মেপে মেপে।
এই চিঠি সেই দিন লিখে পরদিন, পয়লা ডিসেম্বর রাজশাহী প্রধান ডাকঘর থেকে পোস্ট করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান ডাক বিভাগ তখন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। রাজশাহী ছিল পশ্চিমাঞ্চলে, যার প্রধান কার্যালয় ছিল খুলনায়। তাই খুলনার প্রধান ডাকঘর জিপিও হলেও রাজশাহীর প্রধান ডাকঘর জিপিও ছিল না।
যুদ্ধকালে এই চিঠি সেন্সর করে পাঠানোর জন্য হয়তো ২ বা ৩ ডিসেম্বর অনুমতিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সাধারণ মানুষের চলাফেরা ও জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ে। ডাক যোগাযোগের ব্যবস্থাও থমকে যায়। ফলে এই চিঠি রাজশাহী প্রধান ডাকঘরে পড়ে থাকে। রাজশাহী শহর মুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তার দাপ্তরিক কার্যক্রম চালু করে। কিন্তু প্রভূত ক্ষতির কারণে রাজশাহীর সঙ্গে সারা দেশের ডাকব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে আরও কিছুদিন লেগে যায়। ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির শুরুতে রাজশাহীর সঙ্গে ডাকযোগাযোগ শুরু হয়। তারপর এই চিঠি খুলনায় পাঠানো হয়। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি ডাকঘর থেকে চিঠিটি বিলি করা হয়।
মুর্তাজার চিঠি
প্রিয় আনিস,
মে মাসের মাঝামাঝি আমি তোমার ওখানে গিয়েছিলাম কিন্তু তোমাকে পাইনি বা তোমার কোনো খবরও পাইনি। সে কারণে, তোমার বাসার ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম কিন্তু তারও কোনো উত্তর পাইনি। তুমি কোথায় আছ আর কেমন আছ তা যত দ্রুত সম্ভব জানিও।
তোমার জন্য উদ্বেগ বাদ দিলে, আমরা ভালোই আছি।
সর্বদা তোমারই
মুর্তাজা
১০ পয়সার একটা সাধারণ পোস্টকার্ডে খুবই সাধারণ একটা চিঠি। কিন্তু সময়কাল এই সাধারণ চিঠির প্রতিটি শব্দের আড়ালে যে অব্যক্ত আকুতি আর কষ্ট লুকিয়ে আছে, তা মূর্ত করে তোলে।
এই চিঠি পাঠানো হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ জুলাই। ইপিআইডিসি সড়ক টিএসও (টাউন পোস্ট অফিস), খালিশপুর, খুলনা থেকে। চিঠির লেখক মুর্তাজার বাড়ি খুলনার খালিশপুরে। চিঠিটা লেখা হয়েছিল আনিসুজ্জামান খান চৌধুরী, প্রযত্নে: নাভানা মোটর ওয়ার্কস, ২৮/সি মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-২ এই ঠিকানায়। চিঠিটা ১৯৭১ সালের ২০ জুলাই ঢাকা জিপিও থেকে ডেলিভারি করা হয়েছিল।
জানি না, চিঠিটা আনিসের হাতে পৌঁছেছিল কি না। এটাও জানা যায়নি এই আনিস বা মুর্তাজা কে ছিলেন, দুজনের মধ্যে সম্পর্কই বা কী ছিল। এ–ও জানি না, আনিস আর মুর্তাজার আবার দেখা হয়েছিল কি না। তবু যখনই এই ছোট্ট কাগজের টুকরাটা হাতে নিই, একটা অদ্ভুত কষ্ট আমাকে আচ্ছন্ন করে। খুলনার এক বন্ধুর কাছে জেনেছি, ২০ থেকে ২৫ বছর আগে মুর্তাজা যে ঠিকানা ব্যবহার করেছেন, সেই বাড়ির মালিকানা বদল হয়েছে।