১০ অক্টোবর সকাল ১০টা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের ঝুপড়িতে বসে গল্প করছিলেন একদল শিক্ষার্থী। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, নানা কিছুই উঠে আসছিল। ঠাট্টার ছলে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে শীর্ষ রাজনীতিবিদদেরও সমালোচনা করছিলেন তাঁরা। এক ফাঁকে আমিও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলাম। জানলাম, সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানা অভিযোগ ও আশার কথা শুনিয়ে শেষে সাজ্জাদ হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী যোগ করলেন, ‘ভয়ের সংস্কৃতি আর ফিরে না আসুক, এটাই চাওয়া। এই যে ঝুপড়িতে বসে মন খুলে আড্ডা দিচ্ছি, ভিন্নমত প্রকাশ করছি, আগেপিছে ভাবতে হচ্ছে না, ক্যাম্পাসে এই পরিবর্তন ধরে রাখা দরকার।’
সাজ্জাদ হোসেনের মতো একই সুরে কথা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থী। মন খুলে কথা বলা যাবে, গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে উঠবে, মুক্তচিন্তা চর্চার একটা ক্ষেত্র হয়ে উঠবে ক্যাম্পাস—প্রশাসনের কাছে এটাই শিক্ষার্থীদের চাওয়া। বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এমদাদ উল্লাহ যেমন বলছিলেন, ‘বিগত বছরগুলোয় আমরা জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে অপরাজনীতি চর্চার কারখানা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখেছি। এই পরিবেশ আর চাই না। সত্যিকার অর্থে নতুন জ্ঞান উৎপাদনের কারখানা হয়ে ওঠে যেন বিশ্ববিদ্যালয়, যে জ্ঞান খেটে খাওয়া মানুষকে তাঁর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধি এনে দেবে।’
তিন মাস পর স্বাভাবিক
গত ১ জুলাই থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সেদিন থেকেই সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতিতে ছিলেন শিক্ষকেরা। পরে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক পর্যায়ে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১৭ জুলাই থেকে ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে’ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। সরকার পতনের পর গত ১৯ আগস্ট থেকে শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিন্ডিকেট। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এ সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়। উপাচার্য, দুই সহ-উপাচার্যসহ প্রশাসনে যুক্ত বেশ কয়েকজন শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন শিক্ষার্থীরা। পরে ১১ আগস্ট উপাচার্য, সহ-উপাচার্যসহ অন্তত ৪০ শিক্ষক প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করেন। এর পর থেকে স্থবির হয়ে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম। পরে ১৯ সেপ্টেম্বর উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। পরে তিনি প্রক্টর, ১৪ হলের প্রাধ্যক্ষসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পুনরায় নিয়োগ দেন। ৬ অক্টোবর থেকে সশরীর শ্রেণি কার্যক্রমও শুরু করেন। দীর্ঘ সাত বছর পর ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোয় শৃঙ্খলা ফিরে আসে। চাঁদাবাজি ও বাকির ভোগান্তি না থাকায় স্বস্তিতে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দোকানিরাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করতে যা যা দরকার, কর্তৃপক্ষ তা করার চেষ্টা করছে। গ্রন্থাগারে ছাত্রদের ফিরিয়ে আনা, নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষার মাধ্যমে সেশনজট দূর করা, নিরাপদ ও উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা আমরা শুরু করেছি।’
শৃঙ্খলা আনতে কমিটি, বিজ্ঞপ্তি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা উন্নয়ন কমিটি’ করেছে কর্তৃপক্ষ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিরোধিতা করেছে, এমন অভিযোগে কোনো শিক্ষার্থী যেন মারধর অথবা ‘মব জাস্টিসের’ শিকার না হন, সেটিই এই কমিটির মূল লক্ষ্য বলে জানানো হয়েছে। ৭ অক্টোবর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী আক্রমণ, হুমকি বা হেনস্তার শিকার হয়ে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শান্ত থাকার অনুরোধ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত যে কেউ চাইলে সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা উন্নয়ন কমিটির কাছে প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। কমিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। কোনোভাবেই আইন নিজ হাতে তুলে নিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো যাবে না।
হৃদয় ও ফরহাদকে স্মরণ
দীর্ঘ বিরতির পর ৬ অক্টোবর ক্যাম্পাসে ফেরার উচ্ছ্বাস ছিল সবার চোখেমুখে। তবে আন্দোলনের সময় যে সহপাঠীদের হারিয়েছেন, তাঁদের কথাও ভোলেননি শিক্ষার্থীরা। ইতিহাস বিভাগে ছিল ভিন্ন আয়োজন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এই বিভাগের দুই শিক্ষার্থী প্রাণ দিয়েছেন—হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ও মো. ফরহাদ হোসেন। ক্যাম্পাস খোলার দিনে ক্লাসরুমে না থেকেও যেন তাঁরা ছিলেন। সামনের সারির ফাঁকা বেঞ্চে রাখা হয়েছিল তাঁদের ছবি ও ফুল।
ইতিহাস বিভাগের সভাপতি শামীমা হায়দার বলেন, হৃদয় ও ফরহাদের স্মরণে শিক্ষার্থীরা একটা তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন। নতুন সিলেবাসেও এই দুই শহীদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও দুজনকে মনে রাখবে ইতিহাস বিভাগ।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর আগে প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। ৬ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে লাল ব্যাজ পরে সমবেত হন উপাচার্য, সহ-উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা। পরে সেখানে নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণ ও তাঁদের জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।
আবাসনেও ফিরেছে শৃঙ্খলা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মো. সজল হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করেছিলেন পাঁচ বছর আগে, ২০১৯ সালে। বাড়ি বগুড়ায়। এই পাঁচ বছরে নানা চেষ্টা করেও তিনি হলে থাকার সুযোগ পাননি। ছাত্রলীগের দখলদারি আর প্রশাসনের উদাসীনতায় তাঁকে বাড়তি টাকা খরচ করে থাকতে হয়েছে ভাড়া বাসায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর হলে আসন পেয়েছেন তিনি।
১০ অক্টোবর বিকেলে কথা হয় সজলের সঙ্গে। ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি আলাওল হলে আসন পেয়েছেন বলে জানালেন। বলছিলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আর যেন কোনো রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে থাকতে না হয়।’
সজলের মতো প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী বৈধভাবে হলে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। ৪ অক্টোবর রাতে ফলাফলের ভিত্তিতে ছাত্রদের সাতটি হলে বরাদ্দ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ৫ অক্টোবর থেকে শিক্ষার্থীরা হলে উঠছেন। ধাপে ধাপে এই বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি হলের মধ্যে চালু আছে ১২টি। এর মধ্যে ছাত্রদের সাতটি ও ছাত্রীদের পাঁচটি। ছাত্রীদের হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের হাতেই ছিল। তবে গত সাত বছর ছাত্রদের হলে আসন বরাদ্দ না দিয়ে ছাত্রলীগকে একক নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। এসব হলের নিয়ন্ত্রণ রাখতে গিয়ে অন্তত ২১ বার নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সেদিনই তাঁরা ক্যাম্পাস ছেড়েছেন।
ঝুপড়ি ও আবাসিক হলের আশপাশের দোকানগুলোতেও এসেছে স্বস্তি। ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের বাকির কারণে অতিষ্ঠ দোকানিরা জানান, এখন তাঁদের সেই ভোগান্তি নেই। বাকি কিংবা চাঁদার জন্য আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের ঝুপড়ির দোকানি মো. শিপন বলেন, ‘আমার দোকানে প্রায় তিন লাখ টাকা বাকি আছে। প্রায় সব দোকানেই বাকি রেখেছিলেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। আশপাশের বিভিন্ন দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদাও নিতেন তাঁরা। প্রশাসনকে জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন আর এই ঝামেলা নেই।’