বাংলাদেশ র্যাঙ্কিংয়ে ১০০ থেকে ৮৮-তে উঠে এসেছে
জার্মানির হ্যামবার্গের কুহনে লজিস্টিকস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যালান ম্যাককিনন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। পড়ুন নির্বাচিত অংশের অনুবাদ
‘সাপ্লাই চেইন’ (সরবরাহ শৃঙ্খল) বিষয়ক পড়ালেখার পেছনে আমি জীবন উৎসর্গ করেছি। আজকের স্নাতকেরা যে কাজের দুনিয়ায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে, সেই দুনিয়া আর আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে সাপ্লাই চেইন কেন গুরুত্বপূর্ণ—সে কথাই আজ বলব।
আমরা যেসব পণ্য ও সেবার ওপর নির্ভর করি, বিস্তৃত এক সাপ্লাই চেইনের ভেতর দিয়েই সেগুলো আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়। এর মাধ্যমেই অর্থনীতি ঘুরপাক খায় বৈশ্বিক, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে। লাখো মানুষ যেমন মানবিক সহায়তা পায়, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাতেও সাপ্লাই চেইনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কেননা সাপ্লাই চেইনে শুধু বস্তুগত পণ্যই বহন হয় না। বরং তথ্য, অর্থ, পরামর্শ, প্রশিক্ষণ—সবই ছড়িয়ে পড়ে। অথচ অবাক করা ব্যাপার হলো, সাপ্লাই চেইনের ওপর এতখানি নির্ভরশীলতা সত্ত্বেও এ নিয়ে আমরা খুব একটা কথা বলি না। হ্যাঁ বলি, যখন সরবরাহটা ব্যাহত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এ রকম উদাহরণ আমরা দেখেছি। যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ, সাইবার হামলা কিংবা মহামারির কারণে যখন সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে, তখনই বিষয়টা আমরা আমলে নিই।
এ কারণেই সাপ্লাই চেইনের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলা দরকার। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের স্নাতকদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনে এর বিশেষ ভূমিকা আছে।
কাজের অপার সুযোগ
সবাই কোনো না কোনো সাপ্লাই চেইনের হয়ে কাজ করে। এমনকি এ–বিষয়ক কোনো প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা ছাড়াই অনেক স্নাতক সাপ্লাই চেইন বা লজিস্টিকস–সংক্রান্ত চাকরিতে ঢুকে পড়ে। লজিস্টিকস বলতে বোঝাচ্ছি পণ্যের ব্যবস্থাপনা, পরিবহন কিংবা সংরক্ষণ। বৈশ্বিক অর্থনীতির ১২ শতাংশ নির্ভর করে লজিস্টিকসের ওপর। সম্ভবত এই খাতে চাকরির পরিমাণও ১২ শতাংশের কাছাকাছি। এর সঙ্গে যোগ হবে সাপ্লাই চেইনের অন্তর্ভুক্ত আরও অনেক কর্মক্ষেত্র। যেমন প্রকিউরমেন্ট, তথ্যপ্রযুক্তি, বিমা, পণ্য বা সেবা পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি। বুঝতেই পারছ, কত বড়সংখ্যক চাকরির সুযোগ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
এ খাতে দক্ষদের চাহিদা আর চাকরি দিন দিন বাড়লেও উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাতটি অনেকটাই অবহেলিত। আমরা সরকার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুরোধ জানিয়েছি, যেন এই খাতের পেশাকে আরও আকর্ষণীয় করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরামর্শ দিয়েছি, তারা যেন সাপ্লাই চেইনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের পরিধি বাড়ায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি জার্মানিতে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে সাহায্য করেছি, যেখানে শুধু লজিস্টিকস ও সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনা নিয়েই পড়ালেখা হয়। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও আমি এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাব।
বাংলাদেশের অবস্থান
আমি বুঝতে পারি, বাংলাদেশ এখন জাতীয় লজিস্টিকস উন্নয়ন নীতি তৈরি করছে, বিশ্বব্যাংকের ‘লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর সার্ভে’তে নিজেদের র্যাঙ্কিং ওপরে তোলার চেষ্টা করছে। পরিবহন অবকাঠামো, সময়মতো পণ্য পৌঁছানোর সক্ষমতা, কাস্টমসের কার্যপদ্ধতিসহ লজিস্টিকসের নানা দিক বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংক দুই বছর পরপর একটি র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এই র্যাঙ্কিংয়ে ১০০ থেকে ৮৮-তে উঠে এসেছে। অথচ আমার দেশ যুক্তরাজ্য এ সময়ের মধ্যে ৯ থেকে ১৯তম অবস্থানে চলে গেছে। অর্থাৎ আমাদের অবস্থান যখন খারাপের দিকে যাচ্ছে, তোমরা তখন এগোচ্ছ। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গবেষণা বলে, এই র্যাঙ্কিংয়ের সঙ্গে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে এ কথা আরও বেশি সত্য। কারণ, এ দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় অংশই নির্ভর করছে রপ্তানি বৃদ্ধির ওপর।
প্রতিবছর সমুদ্রপথে ১১ বিলিয়ন টন কার্গো পরিবহন হয়। এই ওজনের পণ্য যদি বিশ্বের প্রত্যেক মানুষকে ভাগ করে দেওয়া হতো, তাহলে একেকজনের ভাগে পড়ত ১ দশমিক ৫ টন। ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ফোরাম বলছে, ২০৪০ সালের মধ্যে পণ্য পরিবহনের পরিমাণ ৫০ শতাংশ বাড়বে। সবাই অবশ্য এই তত্ত্বের সঙ্গে একমত নয়। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলেন, আন্তর্জাতিক ব্যবসার হার কমবে। প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি স্থানীয়করণ করবে। এর বড় কারণ—ঝুঁকিপূর্ণ সাপ্লাই চেইন। যুদ্ধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, চরম আবহাওয়া, রোগবালাই, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সাইবার হামলার মতো নানা কারণে সাপ্লাই চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আজকের পৃথিবীতে ভূরাজনীতির কারণে সাপ্লাই চেইন যতখানি ব্যাহত হচ্ছে, এতটা আগে কখনো হয়নি। এমনকি অনেক দেশ অন্যান্য দেশের ওপর অসামরিক ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য এটিকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে।
সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। ২০২৩ সালেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা এতটাই রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে যে জলবায়ুবিজ্ঞানীরাও চমকে গেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা গভীরভাবে উদ্বিগ্নও হয়ে পড়েছেন। এর ফলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে, তারা যেন তাদের সাপ্লাই চেইনে যতটা সম্ভব কম কার্বন নিঃসরণ করে। জলবায়ুসংক্রান্ত যুদ্ধে বাংলাদেশ যেহেতু একেবারেই সম্মুখ সারিতে, তাই পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে লজিস্টিকস ও সাপ্লাই চেইনের সক্ষমতা বাড়ানো এ দেশের জন্য আরও বেশি জরুরি। (সংক্ষেপিত)