ডান হাত চুলকালে সত্যিই কি টাকা আসে?
এগুলোকে আজকের দিনে বেশির ভাগ মানুষ বলে কুসংস্কার। কিন্তু একসময় এগুলোই ছিল মানুষের সাধারণ বিশ্বাস। যেমন খেতে গিয়ে কারও হয়তো বিষম লেগেছে, বলা হতো তাকে নিশ্চয় কেউ স্মরণ করছে! আবার, ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে হয়তো কেউ বাধা পেল। একটু বসে যেতে বলা হতো, নইলে অমঙ্গল হবে! শুধু বলা হতো তা–ই না, মানুষ এগুলোকে বিশ্বাসও করত।
এ রকম আরও কিছু বিশ্বাস মানুষের ছিল, যেগুলোর প্রায় সব কটিই মানুষ এখন অবিশ্বাস করে। যেমন একবার খাবার মুখে নিলে পানিতে পড়তে হয়। পানিতে পড়ার আগে সত্যিই কেউ একবার মুখে খাবার নিয়েছিল কি না, এর প্রমাণ আজ আর কেউ হাজির করতে পারবে না। কিংবা শুনেছেন নিশ্চয়, ডান হাত চুলকালে টাকা আসে। এ রকম ব্যাপার সত্যি হলে ডান হাতে চুলকানিকেও সবাই স্বাগত জানাত! আবার, জোড়া কলা খেলে যমজ বাচ্চা হয়। তা–ই যদি হতো, তবে নিঃসন্তান দম্পতিদের জন্য প্রেসক্রিপশনে জোড়া কলা লিখে দিতেন ডাক্তার!
দুই হাজার বছর আগে লেখা কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকেও এমন বিশ্বাসের কথা আছে। রাজা দুষ্মন্ত শিকারে গিয়েছেন। হরিণের পেছনে ধাওয়া করতে গিয়ে তপস্বীদের আশ্রমের কাছে চলে গেলেন তিনি। তখন হঠাৎ করে তাঁর ডান চোখের পাতা কাঁপতে থাকে। এ রকম হলে প্রণয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়। খানিক বাদে সেটিই সত্যি প্রমাণিত হয়। তপস্বীকন্যা শকুন্তলাকে দেখে রাজার মনে প্রেম জাগে। আবার মৈমনসিংহ গীতিকার ‘দেওয়ানা মদিনা’ পালায় আছে: দুলাল ঘর থেকে বের হওয়ার সময় হাঁচির শব্দে বাধা পায়। এরপর পথে বের হতেই নিচু জাতের এক লোকের সঙ্গে তার দেখা হয়। খানিক বাদে সে গর্ভবতী শেয়াল দেখতে পায়। মাথার ওপরে কাক-চিলের ডাক শুনতে পায়। এত সব অলক্ষণ দেখে সে মনে মনে বলে, ‘না জানি আল্লাজী আমার কী লেখ্ছুইন কপালে।’
এসব ঘটনার কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? বিজ্ঞান বলে, কোনো একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এসব বিশ্বাস বা ধারণা মানুষের মধ্যে তৈরি হতে পারে। শুধু কাকতাল বলে এগুলোকে ফেলে দেওয়া যাবে না। হয়তো কোনো কোনো ব্যাপার বারবার ঘটতেও দেখা যেত। তাই বলে, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এসব সম্পর্ককে বৈজ্ঞানিক বলা যাবে না। যেমন একসময় বিশ্বাস করা হতো, ঘরে বাদুড় ঢুকলে কঠিন অসুখ হয়। আজকের বিজ্ঞান তো দেখিয়েই দিয়েছে, বাদুড় কী ভয়ংকর ভাইরাস বহন করতে পারে।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়গুলোকে বিজ্ঞান বিপরীতভাবে ভাবতে বলে। জসীমউদ্দীনের ‘পল্লিজননী’ কবিতার কথা মনে করুন। ছেলে অসুস্থ। তার মাথার কাছে মা বসে আছেন। গভীর রাত। দুশ্চিন্তায় মায়ের চোখে ঘুম নেই। ওই সময়ে একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। মা তাঁর পুরোনো বিশ্বাসে অমঙ্গলের ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন। আসলে ব্যাপারটা কী? প্যাঁচা নিশাচর প্রাণী। সে তো রাতেই ডাকবে। অন্যদিনও ডাকত। মা অন্য রাতগুলোতে ঘুমিয়ে থাকতেন বলে ওই ডাক শুনতে পেতেন না। আজ শুনতে পাচ্ছেন। কারণ, আজ তিনি জেগে রয়েছেন।
আবার ধরুন, সপ্তাহের কোনো কোনো দিন যাত্রা শুভ নয়। এর পেছনে সামাজিক ইতিহাসের চিহ্ন আছে। এখনো আমরা সপ্তাহের সব দিন সব কাজ করি না। বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ বিশেষ কাজ করি। হয়তো সপ্তাহের কোনো দিন হাট বসত কিংবা মানুষ বিশেষ কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত। তাই ওই দিনগুলোতে দূরে যাত্রা করতে নিষেধ করা হতো।
কোনো কোনো ঘটনার সঙ্গে কাকতালের সম্পর্ক আছে। বিষম খাওয়ার ব্যাপারটাই ধরুন। সুদূর অতীতে কীভাবে এটি বিশ্বাসের অংশ হলো? কোনো এককালে হয়তো খেতে গিয়ে কারও বিষম লেগেছিল। তিনি ওই ঘটনা পরে হয়তো কাউকে বলেছিলেন। ঘটনা শুনে শ্রোতা বললেন, ‘আরে! ওই সময়ে আমি তো তোমার কথাই ভাবছিলাম!’ এখন ব্যাপারটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? একে কাকতালই বলতে হবে।
সামাজিক ইতিহাস বা কাকতাল যা–ই হোক না কেন, এ ধরনের সংস্কারের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক নেই। তবে মজার ব্যাপার হলো এগুলো মানা না-মানার ব্যাপারে বিজ্ঞান কোনো সিদ্ধান্ত দেয় না। যেমন রাতের বেলা চুল বা নখ কাটতে নেই। আপনি এটি বিশ্বাস করে না–ই কাটতে পারেন। কিন্তু অতীতের কথা ভেবে দেখুন। একসময় বৈদ্যুতিক বাতি ছিল না। তখন প্রদীপের মৃদু আলোয় চুল-নখ কাটতে গেলে কিছু ঝামেলা হওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু আজকের দিনে ঝলমলে আলোর সেলুনে রাতের বেলায় চুল কাটাতে আপনার আপত্তি হওয়ার কথা নয়।
বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও এসব সংস্কারের সঙ্গে মানুষের মনের গভীর সম্পর্ক আছে। মনোবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। তাঁরা মনে করেন, মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে তার কাজের মনোযোগ অনেকখানি নির্ভর করে। যেমন দিনের শুরুটা খারাপ দেখে আপনি হয়তো সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ পুরো দিনটাই খারাপ যাবে। তাহলে সেই দিনটার সফলতাগুলোও ঢাকা পড়ে। তাই সংস্কারের বিধিনিষেধকে মনোবিজ্ঞানীরা জাপটে ধরে থাকতে নিষেধ করেছেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বাসগুলো যে কাজকে সুন্দর করে, তা–ও তো মানতে হয়। ধরুন, তাড়াহুড়া করে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে বাধা পেলেন। তখন আসলে কী করা উচিত? তখন একটু জিরিয়ে নিয়ে ধীরেসুস্থে বের হওয়াটাই তো ভালো হবে।
আরও কিছু মজার মজার বিশ্বাস দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক। জানেন নিশ্চয়, ইঁদুরের গর্তে দুধদাঁত ফেলতে হয়; তাহলে ইঁদুরের মতো সুন্দর দাঁত হয়। দুধে পিঁপড়া ভাসলেও খেতে সমস্যা নেই; এ রকম দুধ খেলে সাঁতার শেখা যায়। ফলের বিচি গিলে ফেলতে নেই; গিলে ফেললে পেটে গাছ হয়। মাথায় মাথায় একবার ঠোক্কর খেলে আরেকবার মাথায় মাথায় বাড়ি লাগাতে হয়; নইলে মাথায় শিং গজায়। কিংবা শুয়ে থাকা মানুষকে ডিঙিয়ে যেতে নেই; এতে শুয়ে থাকা মানুষটি আর লম্বা হয় না। এমনকি, মাথার বালিশে বসতে নেই; এতে পশ্চাদ্দেশে ফোড়া হয়!
পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষের মধ্যেই এ রকম বিশ্বাস-অবিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে আছে। দীর্ঘদিনের প্রবাহিত বিশ্বাসগুলো ‘কুসংস্কার’ বলে মেনে নিয়েও সব কটি ফেলে দিতে মন সায় দেয় না।