একজনের দল নিয়েই সেরা চুয়েটের তাহসিন
এক মিনিটের ছোট্ট একটা ভিডিও। সেটা তৈরি করতেই লেগেছে পাক্কা দেড় মাস! প্রকৌশলের পড়ার চাপ সামলে অ্যানিমেশন তৈরির পেছনে লেগে থাকাটাও চাট্টিখানি কথা না। তাহসিন আলমের কষ্টটা অবশ্য বৃথা যায়নি। সানহাক শান্তি পুরস্কারের মোশন গ্রাফিকস তৈরির প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গ্র্যান্ড প্রাইজ’ জিতেছেন তিনি। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগে পড়ছেন এই তরুণ।
বিশ্বব্যাপী সংঘাত, দারিদ্র্য, পরিবেশ বিপর্যয়—এমন নানা সমস্যার সমাধান খোঁজাই ‘সানহাক শান্তি পুরস্কার’–এর লক্ষ্য। দক্ষিণ কোরীয় নেত্রী হ্যাক জা হান এ পুরস্কারের প্রবর্তক। তিনি উইমেনস ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিসের প্রতিষ্ঠাতা। সানহাক শান্তি পুরস্কারের মাধ্যমে সেসব ব্যক্তি ও সংস্থাকে সম্মান জানানো হয়, যারা মানবতা ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করে।
প্রতিবছর পুরস্কারের জন্য একটি বিষয় নির্ধারণ করা হয়। এবারের বিষয় ছিল ‘টেকসই জীবন’। পরিবেশের ক্ষতি না করে কীভাবে মানুষ একটা সুন্দর পৃথিবী গড়তে পারে, মূলত সেটিই ছিল প্রতিপাদ্য।
মোশন গ্রাফিকস তৈরির প্রতিযোগিতায় ৬৮টি দেশ থেকে অংশ নিয়েছিল ৩৩১টি দল। পুরো প্রতিযোগিতাই হয়েছে অনলাইনে। তাহসিন জানান, অ্যানিমেশন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল গত ১৫ আগস্ট। বিচারকদের মতামতের ভিত্তিতে সেরা দশের তালিকা প্রকাশ করা হয় ১ সেপ্টেম্বর। সেরা দশে স্থান পাওয়ার পরও পুরস্কার পাবেন কি না, তা নিয়ে তাহসিনের মনে সংশয় ছিল। শেষ পর্যন্ত বিচারকদের রায় ও অনলাইন ভোটের ওপর ভিত্তি করে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয় ২০ সেপ্টেম্বর। সেদিনই তাহসিন জানতে পারেন, প্রতিযোগিতার সেরা পুরস্কারটাই এসেছে তাঁর ঝুলিতে।
নিয়ম অনুযায়ী, সর্বোচ্চ চার সদস্যের দল গঠন করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া যায়। তবে তাহসিন যেহেতু একাই অ্যানিমেশনের কাজ করেন, তাই তাঁর ‘দলে’ তিনিই ছিলেন একমাত্র সদস্য। আইডিয়া সাজানো, স্ক্রিপ্ট লেখা, ছবি আঁকা, স্টোরিবোর্ড করা, সাউন্ড ডিজাইন—সবই তাহসিনকে একা করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল কাজের প্রতি আমার আগ্রহ। শখের বশে টুকটাক কাজ করতাম। করোনার বন্ধের সময় মূলত মোশন গ্রাফিকসে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তখন হাতে অঢেল সময় ছিল, দিনভর অ্যানিমেশন চর্চা করেছি। এটার প্রতি যেহেতু একটা প্যাশন আছে, তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করলেও তেমন কোনো ক্লান্তি আসে না।’
দৈনন্দিন জীবনে ছোট্ট কিছু পরিবর্তন আনলেই কীভাবে আমরা একটা টেকসই পৃথিবী গড়তে পারি, ভিডিওতে সেটিই তুলে ধরেছেন তাহসিন। যেমন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার না করা, নবায়নযোগ্য শক্তি কাজে লাগানো, যখন যেখানে সম্ভব গাড়ির পরিবর্তে সাইকেল ব্যবহার করা, বিভিন্ন সরঞ্জাম পুনর্ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়া, জৈবসারের ব্যবহার বাড়ানো ইত্যাদি। মোশন গ্রাফিকসের মাধ্যমে সহজ ও আকর্ষণীয়ভাবে তাহসিন তাঁর ভাবনা উপস্থাপন করেছেন। তাহসিন বলেন, ‘আমাদের মানসিকতা আর জীবনযাপনের রীতিতে ছোট্ট কিছু পরিবর্তন আনলেই কিন্তু আমরা পরিবেশবান্ধব জীবন গড়তে পারি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ১০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশবান্ধব জীবনের প্রয়োজনীয়তাও নিশ্চয়ই আমরা টের পাচ্ছি। অনেকের কাছে মনে হতে পারে, এত বড় পৃথিবী, আমার একার চেষ্টায় কী-ই বা হবে? কিন্তু না। একজন একজন করেই তো আমরা সম্মিলিতভাবে পরিবর্তন আনতে পারব। এক মিনিটের মোশন গ্রাফিকসে আমি এই বার্তাটাই দিতে চেষ্টা করেছি।’
সানহাক শান্তি পুরস্কারের এ প্রতিযোগিতায় সেরা ১০ দলই পাবে প্রাইজমানি ও সনদ। নিয়ম অনুযায়ী একটি দল পাবে গ্র্যান্ড পুরস্কার—তিন হাজার ডলার। স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড পাবে তিনটি দল—দেড় হাজার ডলার। আর বাকি ছয়টি দল ৫০০ ডলার করে পাবে।
তাহসিন বলেন, ‘শখের বশে অ্যানিমেশনের কাজ করতাম। এ শখ যে আমাকে এত বড় পুরস্কার এনে দেবে, ভাবতেও পারিনি। মোশন গ্রাফিকসের জগৎ অনেক বড়। তার ওপর প্রতিনিয়তই নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে, পরিবর্তন আসছে। মোশন গ্রাফিকসের আরও অজস্র বিষয় শেখার আছে। পড়ালেখার পাশাপাশি আমি এ শিক্ষা চালিয়ে যেতে চাই।’