শিশুর ইংরেজি শেখা কি স্কুলের ওপর নির্ভর করে?
কিছুদিন আগে সন্তানকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে বেশ কয়েক জন অভিভাবককে দেখলাম, সন্তানদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলছেন, ‘এদিকে এসো’; ‘এখানে বসো’; কিংবা ‘দৌড়াদৌড়ি কোরো না’র মতো অতি সাধারণ কথাও তাঁরা বাংলায় বলছিলেন না।
তাঁদেরই একজন আমার সন্তানের সঙ্গেও ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। যেমন কোন স্কুলে পড়ে, কোন ক্লাসে উঠল, চিকিৎসকের কাছে কেন এসেছে ইত্যাদি। বাংলা মাধ্যমের প্রথম শ্রেণি পড়ুয়া এবং ইউটিউবে অনভ্যস্ত আমার সন্তান এখনো ইংরেজিতে সব বোঝে না। স্বভাবতই সে খুব বিব্রত হচ্ছিল।
একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন নাতাশা আহমেদ। তাঁর বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির পরিবারের প্রায় সব শিশুই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। ফলে কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে গেলে নাতাশার শিশুকন্যাটি একেবারে একলা হয়ে পড়ে। বাকি শিশুরা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে যোগাযোগ করে, যা নাতাশার মেয়ের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
অনেক অভিভাবকই আছেন, যাঁরা এখন সন্তানকে ভালো মানের বাংলা স্কুল থেকেও মাঝারি মানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন। বেশির ভাগই বলছেন, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে এর বিকল্প নেই। বিশেষ করে আশপাশের অনেকের সন্তান যখন ইংরেজিতে কথা বলে, যোগাযোগ করে, তখন নিজের সন্তান না পারলে মনে হয় সে পিছিয়ে পড়ছে। ফলে সন্তানকে এগিয়ে নিতেই ইংরেজির প্রতি জোর দিচ্ছেন এই অভিভাবকেরা।
মেয়ে স্বরিৎ ঋতিকে বাংলা থেকে ইংরেজি মাধ্যমে স্থানান্তর করেছেন ঢাকার সাংবাদিক ওয়াসেক বিল্লাহ। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম এর কারণ। ওয়াসেক বলেন, ‘এখনকার শিশুরা ইউটিউব দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে। আমার মেয়েকে দেখতাম, বাংলা মাধ্যমে ভালো করত না। এখন ইংরেজিতে আনার পর সে লেখাপড়ায় ভালো করছে। কারণ, ইংরেজি ভাষার বিভিন্ন কনটেন্ট দেখে সে বড় হচ্ছে।’
বেসরকারি চাকরিজীবী জুয়েল হাসনাত জানালেন অন্য কথা। তাঁর দুই সন্তানই বাংলা মাধ্যমে পড়ে। কিন্তু সেখানে ইংরেজিতে তেমন কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাদের অনলাইনে আলাদা ইংরেজি শেখার কোর্সে ভর্তি করেছেন তিনি। জানালেন, ইংরেজিতে দখল বাড়াতেই এ সিদ্ধান্ত। যেহেতু স্কুল শেখাতে পারছে না বলে তিনি মনে করছেন, তাই নিজেই উদ্যোগী হয়ে শেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আধুনিক জীবনে চলার জন্য ইংরেজির বিকল্প নেই।’
কেন আমাদের ইংরেজির প্রতি ভীতি ও প্রীতি, জানতে চেয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও অনুবাদক জি এইচ হাবীবের সঙ্গে। তাঁর কথা, ‘পৃথিবীর কোনো দেশই মাতৃভাষা ছাড়া উন্নতি করতে পারেনি। যখন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজ বা আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না, তখনো আমাদের দেশের মানুষ ইংরেজিতে লেখাপড়া করেছেন। তাঁরা পেশাগত জীবনে ভালোও করেছেন, শিক্ষকতায় ভালো করেছেন। সময়ের সঙ্গে ইংরেজি নিয়ে আদিখ্যেতা বেড়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় ইংরেজি ভাষায় দখল বাড়েনি।’
বাংলাদেশের মানুষের ইংরেজি নিয়ে মাতামাতিকে ‘বাড়াবাড়ি’ হিসেবে দেখতে চান জি এইচ হাবীব। তিনি বলেন, ‘আমাদের মানসিকতায় সংকট আছে। যাঁরা ইংরেজি জানেন, তাঁরা নিজেদের উঁচু শ্রেণির সদস্য বলে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। ঔপনিবেশিক দাসত্বের মানসিকতা এখনো রয়ে গেছে এই অঞ্চলে।’
দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার একধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে বলে ইংরেজিপ্রীতিও বেড়েছে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
শিশুর মধ্যে কীভাবে বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ববোধ তৈরি করা যায়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে পরিবারকে। শিশু মা–বাবাকে দেখে শেখে। মা-বাবা যদি বাংলা বলেন, বাংলা বই পড়েন; শিশুও শিখবে। এরপরই ভূমিকা রাখতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে, রাষ্ট্রকে। স্কুল–কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। মাতৃভাষাটা যেন শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারে, সেটা লক্ষ রাখতে হবে। মাতৃভাষার গাঁথুনি শক্ত হলে, সে যেকোনো ভাষা সহজেই শিখে নিতে পারবে।’
আধুনিক বিশ্বে চলতে গেলে ইংরেজি জানা প্রয়োজনীয় উল্লেখ করে জি এইচ হাবীব যোগ করেন, ‘তার মানে এই নয় যে ইংরেজির দাস হয়ে যেতে হবে।’