মা-বাবার সংগ্রাম আর আমার আকাশে ওড়া
প্রথম আলোর ইংরেজি বিভাগের কর্মী ছিলেন এন এইচ সাজ্জাদ। স্নাতকোত্তর করতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেন আজ। সাজ্জাদের জীবনে যে এমন একটা সংগ্রামের গল্প আছে, সেটা কাউকে বুঝতে দেননি তিনি। যাওয়ার আগে শুধু লেখাটা পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি চলে যাওয়ার পর ছাপবেন।’ সাজ্জাদের সহকর্মী হিসেবে এই গল্প আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। নিশ্চয় আপনাকেও দেবে।
বাবা স্বপ্ন দেখতেন একদিন আকাশে উড়বেন, বিমানে চড়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাবেন। মরুভূমির তপ্ত রোদে শরীর পুড়ে অঙ্গার করে রিয়াল কিংবা দিনার আয় করবেন। সেই মুদ্রা টাকায় পরিণত করে দূর করবেন পরিবারের দুঃখ-দুর্দশা। শিক্ষিত হবে ছেলেটা, হবে মানুষের মতো মানুষ।
বাবা পাসপোর্ট তৈরি করেন। এলাকার মধ্যপ্রাচ্যগামীদের হাতে পাসপোর্টের ফটোকপি ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভাই, আমার জন্য একটি ভিসা দিয়ো। আমি সব কাজ পারি।’ কিন্তু তাঁর কথায় কারও মন গলেনি। তাই তো কতজন মধ্যপ্রাচ্যে গেল, এল। বাবার যাওয়া হলো না। উল্টো দালালের খপ্পরে পড়ে খোয়া গেল লাখখানেক টাকা। যার পুরোটাই দেনা।
সংসারে অভাব বাড়ল। বাবার অসহায়ত্বে দিশাহারা হয়ে মা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনিও উপার্জন করবেন। স্বপ্ন একটাই, ছেলেটাকে আকাশে ওড়ানো। লেখাপড়া শিখিয়ে শিক্ষিত করা।
বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রি। রোজ সকালে বেরিয়ে পড়তেন। কাজের জন্য গ্রামে গ্রামে সাইকেল নিয়ে ছুটতেন। ফিরতেন রাতে। আর মা কাজের জন্য মানুষের বাড়ি বাড়ি ছুটতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে অল্প কিছু টাকা পেতেন। তা জমিয়ে মাস শেষে দিতেন ছেলের প্রাইভেটের বেতন, স্কুলের পরীক্ষার ফি।
আমার পালা
বয়স কম থাকায় মা-বাবার দুঃখগুলো বুঝতাম না। তাই তো সময় পেলেই পড়াশোনা বাদ দিয়ে দুরন্তপনায় মেতে উঠতাম। খালে-বিলে, মাঠে-ঘাটে বন্ধুদের নিয়ে ছুটতাম। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কষ্টগুলো আমার শরীরে তিরের মতো বিঁধতে লাগল। পণ করলাম, এই কষ্ট বৃথা যেতে দেব না।
সালটা ২০১৩। আমি এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলাম। ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম কলেজে (মানবিক বিভাগ)। একদিন হঠাৎ বাবা বললেন, ‘বাবা, আমাকে তোর ভাত (ভরণপোষণ) দিতে হবে না। আমি চাই তুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়। তাইলেই আমি খুশি।’ এমন আকুতি শুনে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। শুধু নিজেকে প্রশ্ন করলাম, ‘পারব তো?’
২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর, বাবার স্বপ্নপূরণের দিন। কারণ, এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটের ফল প্রকাশিত হয়। আমি হই ৮০৮তম। বাবা শুনে আনন্দে আত্মহারা। মিষ্টি কিনে এলাকার সবাইকে খাওয়ালেন। এপাড়ায়-ওপাড়ায় সবাইকে বলে বেড়ালেন, ‘আমার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে।’
২০১৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, বাবার আরেকটি স্বপ্নপূরণের দিন। এই দিন আমি প্রথম আকাশে উড়ি। ১৫ দিনের সফরে চীনের কুনমিংয়ে যাই। বাংলাদেশ-চায়না ইয়ুথ ক্যাম্পে অংশ নিতে এই ভ্রমণ। সঙ্গে ঢাকা, নর্থ সাউথ ও শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটির ১৫০ শিক্ষার্থী।
আরও বড় স্বপ্ন
২০১৯ সালে ‘কমিউনিটি কলেজ ইনিশিয়েটিভ (সিসিআই)’ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য আবেদন করি। এটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি ১০ মাসের বৃত্তি, যেখানে স্নাতকে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। সাতজনকে এই বৃত্তির জন্য নির্বাচিত করা হয়। তাঁদের একজন হই আমি। পড়াশোনার বিষয় সাংবাদিকতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পেনসিলভানিয়ার নর্থহ্যামটন কমিউনিটি কলেজ। ওই বছর ১৮ জুলাই আমি দেশ ছাড়ি। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে তৃতীয় বর্ষে পড়ি। পরের বছর ১৭ মে দেশে ফিরি।
সমাজবিজ্ঞানে পড়লেও আমার ধ্যানজ্ঞান জুড়ে ছিল লেখালেখি আর সাংবাদিকতা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেই ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রথম আলোর ইংরেজি বিভাগে শিক্ষানবিশ সহসম্পাদক হিসেবে যোগদান করি। তখন আমি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। এর আগে একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি দুই বছর।
২০২২ সালের অক্টোবরে স্নাতক শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে পড়ার জন্য আবেদন করি। বিষয় সাংবাদিকতা। এরপর প্রায় পাঁচ মাস ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। অস্থিরতায় দিন কাটত। রাতে বারবার ই-মেইল চেক করতাম। কখন আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত মেইল! যেটি দুঃখ ঘোচাবে পরিবারের। দীর্ঘ সংগ্রামের ইতি ঘটিয়ে দুদণ্ড শান্তি দেবে মা-বাবাকে।
অবশেষে ৭ মার্চ সকালে ঘুম থেকে উঠেই ই-মেইলে একটি চিঠি পেলাম। এসেছে ইউনিভার্সিটি অব নেভাদা, রেনো থেকে। যেখানে লেখা, ‘রেনল্ড স্কুল অব জার্নালিজমের শিক্ষকেরা আপনার আবেদন গ্রহণের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এ ছাড়া আমরা আপনাকে গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ অফার করছি। যার জন্য মাসে ১ হাজার ৭০০ ডলার বেতন দেওয়া হবে এবং পড়াশোনা বাবদ আপনাকে কোনো খরচ দিতে হবে না৷’
দু-তিনবার চিঠিটি ভালো করে পড়ে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সুসংবাদটি প্রথমে মাকে জানাই। বাবা তখন সাইকেল নিয়ে কাজে বেরিয়েছেন। শুনে মায়ের আনন্দে কাঁদো কাঁদো অবস্থা।
দিন শেষে মা-বাবার স্বপ্নগুলো হয়তো পূরণ হয়েছে। কিন্তু তাঁদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। শরীরে নানা রোগশোক নিয়ে এখনো তাঁরা রোজ সকালে বিছানা ত্যাগ করে জীবিকার সন্ধানে বের হন। মা একটি ব্যাচেলর মেসে রান্না করেন। আর বাবা বাসা থেকে কয়েক মাইল দূরে সাইকেল চালিয়ে কাজ করতে যান। ছোট বোনটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছি। হয়তো ওকে নিয়েই এখনো তাঁদের দুশ্চিন্তা।
৭ মার্চ সকালেই মাকে বলেছিলাম, ‘মা, ভিসাটা পেলেই কাজটা ছেড়ে দিয়ো। বাবাকে আর কাজে পাঠিয়ো না। আমি বিদেশে গিয়েই টাকা পাঠাব। তোমাদের আর কষ্ট করতে হবে না।’ কিন্তু দুজনেই এখন বলেন, ‘বাবা, তুই আগে যা, কী অবস্থা দেখ আগে। তারপর আমরা একটু শান্তি করব।’
কবে যে তাঁদের সেই শান্তির দিন আসবে, সেই প্রতীক্ষায় আজ ১৩ আগস্ট আবারও আকাশে উড়ব। এবারের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের রেনো শহর।