যেখানে অফিস মাত্র চার দিনের

অধিকাংশ দেশে টানা পাঁচ দিন কাজের পর মেলে দুই দিনের বহু প্রতীক্ষিত ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে তো ছুটি কেবল এক দিন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলের হাওয়া লেগেছে চাকরিক্ষেত্রেও। অনেক দেশেই কর্মদিবস কমিয়ে ছুটি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

কেন চার দিনের কর্ম সপ্তাহ

করোনা পরবর্তী সময়েও অনেকে হোম অফিস করেছেন
ছবি: কবির হোসেন

কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে করোনার সময় থেকে। করোনার প্রকোপে সবাই যখন ঘরবন্দী, তখন বিকল্প হিসেবে শুরু হয় হোম অফিসের প্রচলন। বাসায় বসেও যে নিজের কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায়, সেটা প্রমাণ করেছে হোম অফিস। শুধু কাজ ঠিকমতো শেষ করা নয়, কাজের গতি এবং কার্যকারিতাও বেড়ে গিয়েছিল অনেকখানি। সব মিলিয়ে কর্মক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব এনে দিয়েছিল করোনা। করোনা শেষ হলেও ঘর থেকে দূরে বসে কাজ করা কমেনি। অনেকেই পাকাপাকিভাবে অফিস করা বাদ দিয়ে বেছে নিয়েছেন হোম অফিস। এই হোম অফিস করতে গিয়ে আরেকটি জিনিস উপলব্ধি হয়েছে অনেকের। কর্মীরা যখন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম পান, তাঁদের কার্যকারিতাও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটালে মন যেমন উৎফুল্ল থাকে, তেমন শরীরও পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায়। ফলে তাঁরা যখন কাজে ফেরেন, কার্যকারিতা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।

কীভাবে কাজ করবে চার দিনের কর্ম সপ্তাহ

করোনার পর সাপ্তাহিক ছুটি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে অনেক দেশই। তার অগ্রভাগে ছিল ইউরোপের কয়েকটি দেশ। ‘ফোর-ডে ওয়ার্ক উইক’ বা ‘৪ দিনের কর্ম সপ্তাহের ধারণায়’ কাজের পরিমাণ সমানই থাকবে, শুধু কমে আসবে দিনের সংখ্যা। অর্থাৎ একজন চাকরিজীবী পাঁচ দিনে যে পরিমাণ কাজ করতেন, ঠিক সেটাই করবেন, কিন্তু ৪ দিনে। বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। একজন চাকরিজীবী প্রতিদিন ৯টা থেকে ৫টা, ৮ ঘণ্টা কাজ করেন। অর্থাৎ পুরো সপ্তাহ শেষে সেটা দাঁড়ায় ৪০ ঘণ্টায়। ৪ দিনের কর্ম সপ্তাহ হলে তিনি আগের পরিমাণেই কাজ করবেন, কিন্তু চার দিনে। অর্থাৎ প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার বদলে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। বিনিময়ে প্রতি সপ্তাহে মিলবে আরও এক দিন বেশি ছুটি। যদিও সব দেশের নিয়ম এক রকম নয়। দেশ, কর্মক্ষেত্র ও কাজের ধরনভেদে কর্মঘণ্টার হেরফের রয়েছে। তবে ৪ দিনের কর্ম সপ্তাহ কিন্তু আর নিরীক্ষাধর্মী প্রক্রিয়া বা ‘ট্রায়াল প্রসেসে’ নেই। বরং ইউরোপের বেশ কিছু দেশে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে চার দিনের কর্মযজ্ঞ।

বাংলাদেশে কর্মজীবিরা সপ্তাহে কাজ করে ৪০ ঘণ্টা
ছবি: কবির হোসেন

বেলজিয়াম

বেলজিয়ামে চার দিন কাজ করেন সে দেশের নাগরিকেরা। ২০২২ সালের নভেম্বরে বেলজিয়ামে পাস করা হয় এই আইন। কাজ চার দিনের হলেও কর্মঘণ্টা ঠিক আগের মতোই আছে। যে কারণে সপ্তাহের চার দিন তুলনামূলকভাবে বেশি কাজ করতে হয় বেলজিয়ানদের। তবে সপ্তাহ শেষে এক দিন বেশি ছুটি মেলে ঠিকই।

সংযুক্ত আরব আমিরাত

সংযুক্ত আরব আমিরাতে সব সরকারি চাকরিজীবীরা চার দিন কাজ করেন। যদিও বেসরকারি চাকরিজীবীদের এখনো পাঁচ দিন কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আস্তে আস্তে চার দিনের কর্ম সপ্তাহে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

আইসল্যান্ড

চার দিনের কর্ম সপ্তাহ চালু আছে আইসল্যান্ডেও। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চলে এই প্রক্রিয়া। করোনার পর থেকে পাঁচ দিনের কর্ম সপ্তাহে ফেরত যায়নি তারা। ফোর্বসের মতে, ২০২৩ সালে আইসল্যান্ডের প্রায় ৯০ শতাংশ চাকরিজীবী সপ্তাহে মাত্র চার দিন কাজ করেন।

তিনদিন ছুটি কাটিয়ে কর্মীরা যখন কাজে ফেরেন, কার্যকারিতা বেড়ে যায় কয়েক গুণ
ছবি: লিংকডইন থেকে নেওয়া

লিথুয়ানিয়া

লিথুয়ানিয়া এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ৪ দিনের কর্ম সপ্তাহে পা দেয়নি। তবে ২০২১ সালে পাস হওয়া এক আইন অনুযায়ী যেকোনো শিশুর পিতা-মাতা চাইলে চার দিনের কর্ম সপ্তাহ শুরু করতে পারবেন। অর্থাৎ কর্মঘণ্টা ৪০ থেকে কমে ৩২ ঘণ্টায় নামিয়ে আনা হয়েছে। চার দিনের কর্ম সপ্তাহ এখন সেখানে ঐচ্ছিক।

ফ্রান্স

সরকারিভাবে অনুমোদিত না হলেও ফ্রান্সের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে চার দিনের কর্ম সপ্তাহ শুরু করেছে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তাদের শ্রম আইন। ফ্রান্সের শ্রম আইন অনুযায়ী একজন চাকরিজীবী সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৩৫ ঘণ্টা কাজ করতে পারেন। ২০০০ সালের নিয়ম অনুযায়ী তাদের চাকরিজীবীরা প্রতিদিন ৭ ঘণ্টা কাজ করতেন। এখন কর্ম সপ্তাহ কমিয়ে এনে ঠিকই ৩৫ ঘণ্টার কোটা পূরণ করছেন তারা। ফ্রান্সের শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির প্রায় ১০ হাজার চাকরিজীবী এখন সপ্তাহে চার দিন কাজ করেন।

এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে চার দিনের কর্ম সপ্তাহের ট্রায়াল বা প্রক্রিয়া। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, জাপান আছে। পর্তুগাল, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অফিসে এখনো চলছে পরীক্ষা। কমবেশি সব জায়গা থেকেই ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন তাঁরা। কিছু কিছু অফিস ইতিমধ্যে চার দিনের কর্ম সপ্তাহ শুরুও করে দিয়েছে। আমাদের দেশেও কি নতুন করে ভাবার সময় এসেছে?

তথ্যসূত্র: টেক ডট কো, ব্লুমবার্গ