সুন্দরবনের মায়ায় নিজের দেশ ছেড়ে আসা এলিজাবেথের গল্প
বাংলাদেশের ডলফিন, শুশুক আর হাঙর নিয়ে গবেষণা করছেন সুইজারল্যান্ডের এলিজাবেথ ফাহরনি। এ কাজে তাঁর সঙ্গী স্বামী রুবাইয়াত মনসুর। তাঁদের পরামর্শে সুন্দরবনে ডলফিনের জন্য তৈরি হয়েছে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য আর বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সাবমেরিন ক্যানিয়নে বাংলাদেশের প্রথম সামুদ্রিক সুরক্ষিত অঞ্চল (এমপিএ)। স্বামী–সন্তান নিয়ে ঢাকা ছেড়ে এখন খুলনাতেই থাকেন এলিজাবেথ। তাঁর বাংলাদেশের মায়ায় জড়িয়ে পড়ার গল্প শোনাচ্ছেন শেখ আল-এহসান
প্রয়াত বৈমানিক ফারিয়া লারার সূত্রে প্রথম বাংলাদেশকে চিনেছেন সুইজারল্যান্ডের এলিজাবেথ ফাহরনি। এলিজাবেথকে বাংলাদেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন লারা। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ২০ জনের একটি দল নিয়ে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন এলিজাবেথ। এক মাস ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে দেখেন তাঁরা। এর মধ্যে সুন্দরবনের খাল আর নদ-নদীতেই কাটে পাঁচ দিন। সুন্দরবনে তাঁদের গাইড ছিলেন রুবাইয়াত মনসুর মোগলি। তরুণ রুবাইয়াত তখন তাঁর বাবা হাসান মনসুরের প্রতিষ্ঠান দ্য গাইড ট্যুরস লিমিটেডে একজন ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে ছবি তোলেন।
সুইজারল্যান্ডের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন এলিজাবেথ। শখের বশে বন্য প্রাণীর ছবি তুলতেন। প্রথম ভ্রমণেই বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে যান এলিজাবেথ। বিশেষ করে সুন্দরবন তাঁকে আচ্ছন্ন করে। সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পরও রুবাইয়াত মনসুরের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। চিঠি চালাচালির যুগে দিনে দিনে নিবিড় হয় তাঁদের বন্ধুত্ব। এর মধ্যে রুবাইয়াতও একবার ঘুরে আসেন সুইজারল্যান্ডে।
২০০২ সালের দিকে সুন্দরবন ও রুবাইয়াতের টানে বাংলাদেশে চলে আসেন এলিজাবেথ। গাইড ট্যুরসের নেচার গাইড হিসেবে রুবাইয়াতের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। ২০০৩ সালে বিয়ে করেন তাঁরা। নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেন মনসুর।
এরপর ২২ বছর ধরে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি, ডলফিন, শুশুক, তিমি সংরক্ষণে কাজ করছেন দুজন। এসব প্রাণীর প্রতি সাধারণ মানুষ ও জেলেদের ভালোবাসা বাড়াতে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ। তাঁদের পরামর্শেই সুন্দরবনে ডলফিনের জন্য তিনটি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ও সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সাবমেরিন ক্যানিয়নে বাংলাদেশের প্রথম সামুদ্রিক সুরক্ষিত অঞ্চল (এমপিএ) তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া সামুদ্রিক বন্য জীবন রক্ষা এবং টেকসই মাছ ধরার জন্য আরও দুটি এমপিএ প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁরা।
দুই সন্তানকে নিয়ে চার বছর ধরে খুলনায় বসবাস করছেন এলিজাবেথ-রুবাইয়াত। নিরালা আবাসিক এলাকায় একটা ভাড়া বাসায় থাকেন এই দম্পতি। দুই সন্তানকে ভর্তি করেছেন পাশের এক স্কুলে। ছেলে শান্ত ডিলান মনসুরের বয়স ১৪ বছর, পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। আর মেয়ে আমায়া মারলে মনসুরের বয়স ১২ বছর, পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে।
ঝরঝরে বাংলা বলেন এখন এলিজাবেথ। ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁদের বাসাতে বাংলাতেই কথা হলো। কানে গাঢ় নীল রঙের ডলফিন আকৃতির দুল পরেছিলেন এলিজাবেথ। টেবিলের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল ডলফিন, হাঙর, তিমি–সম্পর্কিত বিভিন্ন বই।
ডলফিন, শুশুক, হাঙরের পিছে পিছে
২০০৩ সালের দিকে ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) বিজ্ঞানী ও আইইউসিএন স্পিসিজ সারভাইভাল কমিটির সিটাসিয়ান বিশেষজ্ঞ দলের এশিয়া সমন্বয়ক ব্রায়ান ডি স্মিথ সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে প্রথম ডলফিন জরিপে নেতৃত্ব দেন। এ কাজের জন্য তাঁরা ভাড়া করেন রুবাইয়াতের নৌযান। ট্যুর গাইড হিসেবে ওই দলের সঙ্গে ছিলেন এলিজাবেথ ও রুবাইয়াত। ডলফিন, শুশুক, হাঙর বা তিমি সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা তখন এই দম্পতির ছিল না। ২৪ দিন জরিপকারী দলের সঙ্গে থাকতে থাকতেই দুজনে শিখে ফেলেন এসব জলজ প্রাণীর নানান প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ। আচরণ, বসবাসের স্থানও জানা হয়ে যায়। ধারণা পাওয়ার পর এসব জলজ প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায়। সুন্দরবন ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ওই দম্পতিকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যান ব্রায়ান ডি স্মিথরা। বিপন্ন এসব প্রাণী সংরক্ষণে উদ্যোগ শুরু করেন এবং সরাসরি ডব্লিউসিএসের সঙ্গে যুক্ত হন।
এলিজাবেথ বলেন, ‘ডলফিন, শুশুক ও হাঙরের বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে। কোনো কোনো প্রজাতি খুবই বিপন্ন, এগুলো ধরা ও খাওয়া একেবারেই নিষিদ্ধ। কিন্তু জেলেরা তা জানেন না। তাই সুন্দরবন–সংলগ্ন জেলে ও এলাকার মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বড় একটি গোলপাতা বহনকারী নৌকা নিই। ওই নৌকায় করে ঘুরে ঘুরে সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় থাকা বনজীবীদের সচেতন করার চেষ্টা করি।’
তাঁদের উদ্যোগের কারণেই বনজীবীরা এখন ডলফিন, শুশুক, হাঙর সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। জালে এসব প্রাণী আটকা পড়লে নদীতে ছেড়ে দেন। যেসব এলাকায় এসব প্রাণীর অবাধ বিচরণ, সেসব এলাকায় জাল পাতেন না, বলছিলেন রুবাইয়াত।
২০১০ সালে ডব্লিউসিএসের উদ্যোগে ঢাকার শিশু একাডেমিতে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় শুশুক মেলা। সার্বিক সহযোগিতা করেন এলিজাবেথ ও রুবাইয়াত। রুবাইয়াত তখন ডব্লিউসিএসের বাংলাদেশ প্রতিনিধি। এরপর তাঁরা উপকূলীয় মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ঘুরে ঘুরে শুশুক মেলা করেছেন।
সুন্দরবনে ১৫ মাস
সুন্দরবনের রূপরহস্য আর জীববৈচিত্র্যের প্রতি এলিজাবেথ-রুবাইয়াত দম্পতির প্রেম যেন দিন দিন বাড়তেই থাকে। ২০১৯ সালেও ঢাকায় থাকতেন তাঁরা। ওই বছরই পরিবার নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সুন্দরবন ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন। এ জন্য ইঞ্জিনবিহীন তাঁদের বড় নৌকাটা হাউসবোটে রূপান্তর করেন। জুলাইয়ে সুইজারল্যান্ডের তিনজন অতিথি আসেন তাঁদের কাছে। এই অতিথিরাও যুক্ত হন তাঁদের মিশনে। দুই ছেলে-মেয়ে ঢাকার স্কুলে পড়াশোনা করত। ভ্রমণের জন্য দুই সন্তানকে স্কুল থেকেও ছাড়িয়ে নেন। ডব্লিউসিএস থেকে এলিজাবেথও এক বছরের ছুটি নেন। এরপর একদিন সন্তান ও অতিথিদের নিয়ে হাউসবোটে চড়ে বসেন। আরেকটি ট্রলারের সাহায্যে চলত এই বোট।
তাঁদের এই বছরব্যাপী যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল প্রশান্তি ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি। সন্তানদের মধ্যে সুন্দরবনের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে জানানোর ইচ্ছাও ছিল আরেকটি উদ্দেশ্য। ২০২০ সালের মাঝামাঝি তাঁদের সফর শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তত দিনে করোনাভাইরাস সংক্রমণে সারা বিশ্ব টালমাটাল। সে জন্য অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সুন্দরবনে আরও তিন মাস কাটায় পুরো পরিবার। সফর শেষে অক্টোবরে খুলনায় নামেন তাঁরা, এরপর থেকে খুলনাতেই আছেন।
কাগজে-কলমে এলিজাবেথ সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি ডব্লিউসিএস ছেড়ে এলিজাবেথ নিজের মতো করেই কাজ করছেন। আর রুবাইয়াত মনসুর পর্যটনে আরও মনোযোগী হয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘সুন্দরবনের আশপাশ থেকে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই।’