সুখী দেশের তালিকার ওপরের দিকে বাংলাদেশ নেই কেন

পোশাককর্মী পোশাক কারখানার মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন না
ছবি: সৌরভ দাস

খবরে এসেছে, সুখী দেশের তালিকায় অনেক নিচের দিকে আছে বাংলাদেশের নাম—একেবারে ১১৭ নম্বরে। উন্নত দেশগুলোর তথাকথিত সুখের মাপকাঠিতে হয়তো আমাদের দেশের মানুষ সুখী নয়। কিন্তু আমি দেখেছি, আমাদের দেশের মানুষ নিজেদের কখনো অসুখী ভাবেন না। আসলে সুখ হচ্ছে, ‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের ক্ষমতা’, সেটা এ দেশের মানুষের মধ্যে ভালোই আছে। যে যেমন অবস্থানে আছে, সেটাতেই তারা সুখী। রিকশাওয়ালা বিরাট গাড়ি-বাড়ির মালিক হতে চান না, পোশাককর্মী (দু–একজন বাদে) পোশাক কারখানার মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন না। তাঁরা নিজেদের কাজে সারা দিন খেটেখুটে যা পান, তাতেই কোনোমতে ঘরে ফিরে নাক ডেকে ঘুমান। হোক সেটা বস্তির ঘর অথবা স্যাঁতসেঁতে নোনা ধরা দেয়ালের ঘর। তাঁদের মধ্যে অসুখী ভাবটা কখনোই দেখি না। তাঁরা প্রতিদিন হাসতে হাসতে, গল্প করতে করতে, দল বেঁধে কাজে যান আবার দল বেঁধে ফিরে আসেন। এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?

১৯৮৮ সালে জাপানের নাগোয়ায় পিএইচডি করতে গিয়েছিলাম। আমি ছিলাম নাগোয়া ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের ছাত্রী। থিসিস লেখার ব্যস্ততার মাঝেই ‘অল জাপান ফরেনার্স স্পিচ কনটেস্ট’–এর খবর পাই। স্বামীর উৎসাহে আমিও নাম লেখাই। বক্তৃতার জন্য জাপানে নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে প্রবন্ধ লিখে জমা দিতে হবে। অনেকে জাপানি বাড়িভাড়া নিয়ে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা লিখে পাঠান, কেউ কেউ জাপানি খাবার খেতে না পারার কষ্ট বর্ণনা করেন। আমি বলি অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কথা, আমার নাগোয়া হাসপাতালে দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা।

জাপান যাওয়ার আগে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও পিজি হাসপাতালে অনেক রোগী দেখেছি। কিন্তু নাগোয়া ইউনিভার্সিটি হসপিটালের হিফুকা বা ডার্মাটোলজি ডিপার্টমেন্টের আউটডোরে রোগী দেখতে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে। একদম কম বয়সী মেয়ে বা ছেলে, হয়তো ২০ থেকে ২৫ বছর বয়স, আমার অভিজ্ঞ শিক্ষক অধ্যাপক মাসারো ওহাসির সামনে বসে যখন মাথার পরচুলা খুলে ফেলছে, দেখি-তাদের মাথায় একগাছি চুলও নেই। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করি, ‘এটা কেন হচ্ছে?’ আমার অধ্যাপক শান্তভাবে উত্তর দেন, ‘এসবের কারণ হচ্ছে স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা।’ দীর্ঘ পাঁচ বছরে এমন আরও নানান ধরনের টেনশনের ফলাফল দেখেছি। এ কারণে আমার বক্তৃতার বিষয়বস্তু বেছে নেওয়া সহজ হয়।

ভালোবাসার কোনো গল্প না থাকলেও এভাবে মন খারাপ করতে হয় না, ছবিটি প্রতীকী; মডেল: ইভান
ছবি: অধুনা

যাঁরা ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে জাপানে থাকেন, তেমন অনেকেই ওই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম এত দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্যে আমারটা বাতিল হয়ে যাবে। জাপানে বিভিন্ন মেয়াদে থাকা বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছ থেকে মোট ১৬৯টি পাণ্ডুলিপি জমা পড়ে। চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের জন্য মাত্র ৯টি প্রবন্ধ টিকে যায়। কীভাবে কীভাবে যেন আমারটাও নির্বাচিত হয়ে যায়।

আমার প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল, ‘শি আওয়া ছেত্তে নান দাত্তে?’ যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘সুখ বলতে কী বোঝায়?’ আধুনিক সমাজে ধনসম্পদ থাকলেই যে মানুষ সুখী হয় না, সে কথাটাই জাপানে আমার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তুলে ধরি! সবাই তুমুল করতালি দিয়ে আমার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। হলভর্তি জাপানিরা আমার চিন্তাভাবনা দেখে অবাক। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরেও তাঁরা আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

সেবার আমি চাম্পিয়ন হয়েছিলাম। যে বাংলাদেশকে ভারতের প্রতিবেশী দেশ বলে পরিচয় করাতে হতো, সেই লাল-সবুজের দেশটিকে একমুহূর্তে খুব সহজে চিনিয়ে দিতে পেরে আমি দারুণ আনন্দিত হয়েছিলাম।

মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের আরও অনেক নমুনা দেখেছি। স্কুলে কিশোর-কিশোরীরা ‘বুলিং’–এর শিকার হয়ে বহুতল ভবন থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করার খবর আসত পত্রিকা ও টিভিতে।

বক্তৃতায় আমি আরেকটা জিনিসের কথা বলেছি। প্রতি মাসে দুবার বড় বড় জিনিস ফেলার তারিখ এলে দেখতাম, খুব কম ব্যবহৃত ভালো ভালো টিভি, ফ্রিজ, সোফা, খাট, আলমারি, ওয়াশিং মেশিন, রাইসকুকার (সবই বাক্সে ভরা ম্যানুয়ালসহ), নতুন খেলনা, বইপত্র—সবই ফেলে দেয়।

এত প্রাচুর্য, এত ধনসম্পদ কিন্তু কেন যেন মনে হত এরা আমাদের মত সুখি না। আমি বক্তৃতায় বলেছি, এই যে তোমাদের বাচ্চাদের এত খেলনা, জামাকাপড়, বইপত্র ফেলে দিচ্ছ, আমাদের দেশের বাচ্চাদের এত জিনিসপত্র নেই, অভাব–অনটনে কোনোমতে ওদের দিন কাটে। কিন্তু ভাঙা একটা টিন বা সাইকেলের একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া চাকা দিয়ে খেলনা বানিয়ে যে আনন্দ সে পায়, তা তো এখানে দেখি না।

সুখ আসলে একটা আপেক্ষিক বিষয়। যে যে অবস্থায় আছি, তাতে সুখী মনে করলেই সুখ। অন্যের সুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললে নিজে কখনোই সুখ পাওয়া যাবে না।

কোভিডের পর চারদিকে তাকিয়ে যখন মনে হলো বেঁচে থাকাটাই বিশাল, অন্য সবকিছু তুচ্ছ। এই সময়ে আমার নিকেতনের নিজ বাড়ির চেম্বার দুই বছর ব্যবহার হলো না। তাই সেখানে ২০২১ সালে আমার এলাকার রিকশাওয়ালা ও কাজে সাহায্যকারী খালাদের ৫-১০ বছর বয়সী শিশুসন্তানদের জন্য ‘আলোকন পাঠশালা’ নামে একটা স্কুল খুলি। এখন ৪০টি শিশুর কলকাকলিতে ভরে থাকে আমার সময়। ওদের চোখেমুখে যে আনন্দ ও আত্মবিশ্বাস আমি দেখি, সেটাতেই অনেক সুখ। আমার দুই নাতনি আমেরিকাবাসী। এখন আর কারণে–অকারণে ওদের মিস করে মন খারাপ হয় না।

গতকাল প্রথম শ্রেণির পাঁচ বছর বয়সী জুনায়েদ আমার কানে কানে বলল, ‘বড় ম্যাম, বড় ম্যাম, আমার আম্মু বলছে, এবার ঈদে আমারে একটা শার্ট কিনা দিব।’ এই যে বছরে একটা শার্ট কেনা, এটা যারা প্রতিদিন শার্ট উপহার পায়, তাদের জন্য কোনো খবর নয়। কিন্তু জুনায়েদের মতো শিশুর জন্য এক বিশাল আনন্দের খবর।