ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়ালেখার যত সুযোগ
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধাক্কায় অনেক পেশাই হারিয়ে যাবে। তবে ফটোগ্রাফির সেই শঙ্কা নেই; বরং শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২০২০ সালের তুলনায় ২০৩০ সালে আলোকচিত্রীদের চাহিদা বাড়বে ১৭ শতাংশ। তাই ফটোগ্রাফিকে শখ থেকে পেশায় পরিণত করছেন অনেক তরুণ। ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়ালেখার কোথায় কী সুযোগ আছে, পড়ুন এই প্রতিবেদনে।
ব্যাচেলর ডিগ্রির সুযোগ
একসময় আমাদের দেশে ফটোগ্রাফি ছিল স্রেফ একটা শখ। এখন সময় বদলেছে। শিক্ষাজীবন থেকেই পুরোদস্তুর পেশাদার আলোকচিত্রী হয়ে উঠছেন অনেক তরুণ। বেসরকারি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফটোগ্রাফি কোর্স তো আছেই; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের অধীনও আলোকচিত্র নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরও করা যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রধান হাবিবা রহমান জানান, ফটোগ্রাফি পেশায় এখন সৃজনশীলতা ও কারিগরি দক্ষতা—দুটিই সমান প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। মুঠোফোন কোম্পানিগুলোও এখন তাদের সেটে উন্নত মানের ক্যামেরা স্থাপনের দিকেই নজর দিচ্ছে বেশি। কারণ, এখন ফটোগ্রাফির দুনিয়া অনেক বিস্তৃত। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের ফটোগ্রাফি বিষয়ের শিক্ষক শরীফুল ইসলাম বলেন, ফটোগ্রাফি শেখার আগ্রহ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। দেশে ও দেশের বাইরে অনেকে স্নাতক ডিগ্রি নিচ্ছেন। গবেষণার সুযোগও তৈরি হয়েছে।
ফটোগ্রাফি শেখার আধুনিক দুই প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশে ফটোগ্রাফি শিক্ষা নিয়ে সেই ১৯৯৮ সাল থেকে কাজ করছে পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটির ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রধান তানভীর মুরাদ বলেন, ‘আমাদের এখানে বেসিক ফটোগ্রাফি কোর্স, ফাউন্ডেশন কোর্স, দুই বছরের প্রফেশনাল প্রোগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত চার বছরের স্নাতক প্রোগ্রাম আছে। বিভিন্ন পেশা ও কাজের জন্য কোর্সগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। পেশাদার ফটোগ্রাফার থেকে শুরু করে আগ্রহী যে কারও জন্য ফটোগ্রাফি শেখার সুযোগ আছে। কোর্সের মাধ্যমে যোগাযোগ, কিউরেশন, লেখালেখির বিষয়গুলো শিখতে পারেন।’ মুরাদ জানান, পাঠশালার শিক্ষার্থীরা অসলো মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যানিশ স্কুল অব জার্নালিজম, ইউনিভার্সিটি অব হ্যানোভার ও রয়েল মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন বিনিময় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। স্নাতক প্রোগ্রামে বৃত্তির সুযোগও আছে। ফলাফল ও মেধার ভিত্তিতে এ বৃত্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিখ্যাত আলোকচিত্রী ও পেশাজীবীদের নিয়ে নিয়মিত কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজন করে পাঠশালা। পাঠশালার বিভিন্ন কোর্সের খবর মিলবে pathshalainstitute.org ওয়েবসাইটে।
আলোকচিত্রসংক্রান্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করে কাউন্টারফটো। প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রিন্সিপাল অনীক মোস্তফা আনোয়ার বলেন, ‘আমাদের ইনস্টিটিউটে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এক বছরের পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন ফটোগ্রাফি কোর্স করা যায়। দুই বছরের প্রফেশনাল ডিপ্লোমা ইন ফটোগ্রাফি কোর্স আছে। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, এক ও দুই মাস মেয়াদি বেসিক ও অ্যাডভান্সড ডিজিটাল ফটোগ্রাফি কোর্স এবং ছয় মাস মেয়াদি ফটোগ্রাফি কোর্স চালু আছে।’ কাউন্টারফটোর কয়েকটি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচি চালু আছে। ভারতের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্রঙ্কস ডকুমেন্টারি সেন্টার ও নেদারল্যান্ডসের টিটসজার্ক আর্ট ক্যাম্পের সঙ্গে বিনিময় কর্মসূচি চালু আছে। নারী শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বৃত্তি। কাউন্টারফটোতে নিয়মিত ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি, ফটোজার্নালিজম, লং টার্ম স্টোরি টেলিং, প্লেন স্পটিং, ফ্যাশন ফটোগ্রাফি, পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি, ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফিসহ নানা বিষয়ে কর্মশালা হয়। বিস্তারিত জানা যাবে counterfoto.org ওয়েবসাইটে।
এ ছাড়া দেশ-বিদেশের নানা প্রতিষ্ঠানে ফটোগ্রাফির ওপর বিভিন্ন ধরনের শর্ট কোর্স ও প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে। দেশের মধ্যে ছায়া ইনস্টিটিউট কমিউনিকেশন অব ফটোগ্রাফি, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফি সোসাইটি (বিপিএস), বেগার্ট ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা, আলফা আর্টস অ্যান্ড ফটোগ্রাফিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ফটোগ্রাফি–সংক্রান্ত কোর্স করায়।
পেশার বিস্তৃতি
বলা হচ্ছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধাক্কায় অনেক পেশাই হারিয়ে যাবে। ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে সেই শঙ্কা নেই; বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বহুল ব্যবহার, প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে সুযোগ দিন দিন বাড়বে। ইউএস ব্যুরো অব লেবর স্ট্যাটিসটিকস বলছে, কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ২০২০ সালের তুলনায় ২০৩০ সালে আলোকচিত্রীদের চাহিদা ১৭ শতাংশ বাড়বে। এই হার বিবেচনা করলে অন্য অনেক পেশার তুলনায় ফটোগ্রাফি এগিয়ে আছে। ফটোসাংবাদিকতা, লাইফস্টাইল ফটোগ্রাফি, ওয়েডিং ফটোগ্রাফি, প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি, ফ্যাশন ফটোগ্রাফি, আর্কিটেকচারাল ফটোগ্রাফি—এসবের সঙ্গে এরিয়াল-স্পেস ফটোগ্রাফি, ড্রোন ফটোগ্রাফির মতো আধুনিক বিষয়ও যুক্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে কাজের সুযোগ।
ভারতের হায়দরাবাদের ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটিতে ডিপার্টমেন্ট অব ফটোগ্রাফিতে পড়ছেন মো. সাব্বির। বলেন, ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়া মানেই যে শুধু ফটোগ্রাফিনির্ভর চাকরি, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়; বিভিন্ন আর্কাইভ, জাদুঘর, গবেষণা সংস্থায় গবেষক, কিউরেটর, বিশ্লেষক হিসেবে কাজের সুযোগ আছে। ডকুমেন্টেশনের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। তাই এ ক্ষেত্রেও কাজ করা যায়। শাটারস্টক, গেটি ইমেজসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ছবি দিয়ে অনেকে ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও আয় করছেন। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানেও এখন আলোকচিত্রীর পদ তৈরি হয়েছে।
বৃত্তি ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ
দেশের বাইরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনার জন্য বৃত্তির সুযোগ আছে।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউবিএস ফিল্ম স্কুলে পড়েছেন রকিবুল হাসান। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর বৃত্তি নিয়ে নেদারল্যান্ডসের এটেনিও দে ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফটোজার্নালিজমের ওপর পোস্টগ্র্যাজুয়েট করেন তিনি। ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাতিসংঘ, রেডক্রস, হেলেন কেলার ফাউন্ডেশনসহ দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থায়। তিনি বলেন, ‘ফটোগ্রাফি নিয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ পাওয়া একটু কঠিন। ইউরোপ–আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃত্তি পাওয়া যায়। আংশিক বৃত্তিসহ করোনার সময়ে নিউইয়র্কের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব ফটোগ্রাফিতে ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।’ যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ইয়েল ইউনিভার্সিটি, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতেও ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ফুলব্রাইট বৃত্তি, চিভেনিং বৃত্তিসহ বিভিন্ন দেশের সরকারি বৃত্তির আওতায় ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে পারেন।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোর্স
অন্য যেকোনো বিষয়ের স্নাতকেরাও চাইলে স্বল্পমেয়াদি কোর্স বা পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্সের মাধ্যমে ফটোগ্রাফির দীক্ষা নিতে পারেন। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাহিন ইসলাম (এনডিসি) বলেন, ‘তরুণ শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের জন্য নানা ধরনের সৃজনশীল ও ব্যবহারিক কোর্স বা প্রশিক্ষণের সুযোগ দিচ্ছে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট। ডিজিটাল ফটোগ্রাফি, পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন ব্রডকাস্ট জার্নালিজম, মডার্ন ব্রডকাস্ট টেকনোলজিসহ নানা বিষয়ে আমাদের এখানে কোর্সের সুযোগ আছে।’ শুধু প্রশিক্ষণ নয়, নানা বিষয়ে গবেষণা ও প্রকাশনার বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। nimc.gov.bd ওয়েবসাইট থেকে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন কোর্স ও প্রশিক্ষণের বিস্তারিত জানা যাবে।
এ ছাড়া প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে (পিআইবি) ফটোগ্রাফির ওপর কোর্স করতে পারেন। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স এবং সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা কর্মসূচিও আছে। সারা বছরই শিক্ষার্থী, গবেষক ও সাংবাদিকদের জন্য ফটোগ্রাফিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ চলে। পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ বলেন, ‘আধুনিক মুঠোফোনসহ নানা প্রযুক্তির সুবাদে ফটোগ্রাফি ও ফটোসাংবাদিকতায় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। মোবাইল জার্নালিজমসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণে আমরা ফটোগ্রাফির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে জানানোর চেষ্টা করছি। ঘটনাবহুল ছবি তোলা, ছবি সম্পাদনা, নকল ছবি-ফেক নিউজ যাচাই-বাছাই, ছবি নিয়ে গবেষণার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে পিআইবি।’ পিআইবির বিভিন্ন কোর্সের খবর জানা যাবে pib.gov.bd ঠিকানা থেকে।