ঘর থেকে সেদিন খালি হাতে জান নিয়ে বের হতে হয়েছিল

১৬ জুনের অঝোর ধারা সুনামগঞ্জবাসীকে ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে পুরো শহর। হাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা লেখক ইকবাল কাগজীর কাছে সেই সময়ের অভিজ্ঞতা শুনলেন খলিল রহমান

সুনামগঞ্জ শহরে ঢুকে গেছে বন্যার পানি
ছবি: খলিল রহমান

সুনামগঞ্জে অতিবৃষ্টি নতুন কিছু নয়। ১৫ থেকে ২০ দিন টানা বৃষ্টি ছোটবেলায় অনেক দেখেছি। ভরা বর্ষায় এই বৃষ্টি আমাদের হাওর জনপদের একধরনের সৌন্দর্য। কিন্তু এখন ভারী বৃষ্টি হলেই চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এত ঘন ঘন বন্যা আগে হয়নি। এমন দুর্যোগ-দুর্ভোগেও মানুষ পড়েনি। আমার আধা পাকা টিনশেড ঘরের দেয়ালে এখনো ২০২২ সালের বন্যার পানির দাগ রয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে গলাপানি ছিল। কী ভয়, আতঙ্ক। কোনো জিনিসপত্র রক্ষা করতে পারিনি সেদিন। চোখের সামনে ঘরে ঢলের পানির স্রোত ঢুকে সব শেষ করে দিয়ে যায়। কত বই ছিল। ৩০ থেকে ৩৫ বছরের সংগ্রহ। বাইশের বন্যায় সব তছনছ হয়ে যায়। খালি হাতে সেদিন ঘর থেকে জান নিয়ে বের হতে হয়েছিল। প্রথমে পাড়ার একজনের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিই। পরে সেখানেও থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সবাইকে নিয়ে এরপর আরেক বাড়িতে গিয়ে উঠি।

এবারও তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, পানি বাড়ছে। তাই ভাবি, এবার প্রস্তুতির সময় পাওয়া গেছে, ঘরের জিনিসপত্র নষ্ট হতে দেব না। আগেভাবেই কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। পরদিন ঈদ। ঢাকা থেকে দুই মেয়ে এসেছে। তাদের নিয়ে জিনিসপত্র গোছাতে থাকি।

আরও পড়ুন
আকস্মিক বন্যার অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন ইকবাল কাগজী
ছবি: খলিল রহমান

এবারও ঘর ছাড়তে হলো

পরদিন সকাল থেকে বৃষ্টি আরও বাড়ে। সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকে পড়ে পানি। বুঝতে পারি, বাড়িতে আর থাকা যাবে না। দরজায় খিল দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। পাড়ার সড়ক দিয়ে পানি ভেঙে যেতে যেতে দেখি, মানুষের ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেছে। শহরের বহু ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। এক প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে উঠি।

বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, অবস্থা বাইশের মতো হবে না। কেন মনে হচ্ছিল, জানি না। কিন্তু কোনো গ্যারান্টি তো নেই। খবরে দেখছি, মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটে পানি। শহরে নৌকা চলছে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে মানুষ। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতির অবনতি হবে। ২০২২ সালের মতো হবে। বৃষ্টি তো হচ্ছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকেই আগেভাগে প্রস্তুতি নিয়েছে। তবু শেষরক্ষা হয়নি। অনেকের ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। ক্ষতি হয়েছে। তারপরও এবারের বন্যার সঙ্গে বাইশের বন্যার কোনো তুলনা চলে না। বন্যা হয়েছে, তবে বাইশের তুলনায় কিছুই না। এখন বন্যার পানি কমেছে। পানি নামায় পরের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফিরেছে লোকজন।

আসলে আশ্রয়কেন্দ্র বলুন আর আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বলুন, সবখানেই একটা কষ্ট আছে। আবার যার ঘরে আপনি উঠলেন, তিনিও সমস্যায় পড়েন; যদিও সবাই বিষয়টি আন্তরিকভাবেই নেন। এটা গত দুটি বন্যায় দেখলাম। মানুষ আসলে মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ায় বলেই একসময় বিপদ কেটে যায়। এবারও সুনামগঞ্জে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত ভবন, নির্মাণাধীন ভবনসহ মানুষের বাড়িঘরে বন্যার্ত লোকজন আশ্রয় নেয়। একে অপরকে সহযোগিতা করে। এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। আশাবাদী করেছে।

বাইশের বন্যায় ইকবাল কাগজীর সংগ্রহের বইগুলোও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল
ছবি: সংগৃহীত

বন্যার জন্য আমরাই দায়ী

১৯৮৮ ও ২০০৪ সালের বড় বন্যা আমি দেখেছি। তখন কিন্তু বাড়ি ছাড়তে হয়নি। সুনামগঞ্জ শহরে পানি আগেও এসেছে, কিন্তু কোথাও থেমে থাকেনি। আবহমানকাল থেকেই ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে বর্ষায় ঢল নামছে। উজানের সেই ঢল আগে সুরমা নদী হয়ে সোজা ভাটিতে চলে যেত। খুব কমই নদীর তীর উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে সেই পানি। আর নদীতে বেশি পানি হলেও শহরের ভেতরে থাকা কামার খাল, বড়পাড়া খাল, ধোপাখালী খাল, বৌলাই খাল হয়ে সেটা দক্ষিণের দেখার হাওরে গিয়ে পড়েছে। শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এসব খাল, জলাধার এখন কোথায়, অনেকে সেটি জানেও না। কোনোটি নালা হয়ে গেছে। কোনোটির উৎসমুখ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে পানি এখন সুনামগঞ্জে এসে দিশাহারা হয়ে পড়ে, পথ খুঁজে পায় না। ভাটির গন্তব্যে যেতে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়। মাঝপথে এই পানি পথ হারানোয় সুনামগঞ্জ বারবার বন্যা হচ্ছে। নাব্যতা হারিয়ে ও সংকুচিত হয়ে পড়ে সুরমা নদীও এই পানির চাপ নিতে পারছে না। হাওরগুলোও ভরাট হয়ে গেছে। যাওয়ার রাস্তা না পেয়ে পানি তাই শহর ও গ্রামে প্রবেশ করে। ভারী বৃষ্টি হলেই মানুষ তাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এবার যেমন ২০২২ সালের ভয়ংকর বন্যার কথা মনে করে মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। আর এখন যে বন্যা হয়, এগুলোর চরিত্রও ভিন্ন। আগে বন্যার পানি এসে দ্রুত ভাটিতে চলে যেত। বড়জোর থাকত তিন দিন। এখন ঢলে স্রোত থাকে বেশি। বন্যার পানি স্থায়ী হয় বেশি দিন। এ কারণে দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতিও হয় বেশি।

সুরমা নদী খনন করতে হবে। নদীর বিভিন্ন স্থানে যেসব খালের উৎসমুখ বন্ধ করা আছে, সেগুলো খুলে দিতে হবে। শহরের খালগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। একই সঙ্গে শহরে সড়কের পাশে থাকা জলাধার ভরাট বন্ধ করতে হবে। এসব অন্যায় প্রতিদিনই হচ্ছে, কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। অপরিকল্পিত নগরায়ণও এই সমস্যার জন্য দায়ী। শুধু নদী নয়, জেলার হাওরগুলো আগের মতো পানি ধরে রাখতে পারে না। হাওর ছিল পানির রিজার্ভ ট্যাংক। এখন হাওরের তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। তাই নদীর সঙ্গে সঙ্গে হাওরগুলোও খনন করতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সমাধান বের করতে হবে।