যে গ্রাম থেকে গয়না যায় বাংলাদেশের সব জেলায়
সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের মেঠো পথ ধরে এক বাড়ির উঠানে উঠে দেখি, ঘরের ভেতর আপনমনে গয়নায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ করে চলেছেন এক নারী। কাজে তাঁর এমনই অখণ্ড মনোযোগ যে আমরা তিনজন জলজ্যান্ত মানুষ উঠানে হাজির হয়েছি, একেবারে কাছে যাওয়ার আগপর্যন্ত সেটা টেরই পান না! তাঁর বয়স হবে ষাটের কোঠায়। এই বয়সেও এমন ধৈর্য নিয়ে হাসিখুশি কাজ করে চলেছেন এই নারী।
নাম তাঁর অঞ্জলি রানী দাস। ৪০ বছর ধরে গয়নার কাজ করছেন। এই গ্রামে বউ হয়ে আসার পরই গয়না গড়ার কাজে হাতেখড়ি। তাঁর স্বামী এবং একমাত্র ছেলেও এই কাজের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। ছেলের ওপর বাড়তি চাপ পড়ুক, সেটা চান না অঞ্জলি রানী। তাই এ বয়সেও নিজের টুকিটাকি প্রয়োজন মেটানোর খরচটুকু জুটিয়ে নেন রুপার গয়নার কাজ করে। সূক্ষ্ম কাজে চাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। দেখতে অসুবিধা হওয়ায় চোখে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে। ছয় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের আগে তাঁরাও এই শিল্পের চর্চা করতেন।
এমনই আরেক নারী সাগরী রানী সরকার। ২২ বছর ধরে গয়নার কাজ করছেন। বিয়ের পর এ গ্রামের মেয়ে-বউদের কাছেই শিখেছেন গয়নার কাজ। প্রথমে সোনার কাজ করতেন। এখন রুপার কাজ। ছয় মাসের মেয়েকে কোলে নিয়েও গয়নার কাজ করেছেন সাগরী রানী। মেয়ে বড় হওয়ার পর সেও হাত লাগিয়েছে। মা-মেয়ে মিলে রোজ হাজার গয়নার কাজ করেছেন, এমনটাও হয়েছে। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সেভাবে এখন আর কাজ করতে পারেন না। তবে এভাবে কাজ করেই কাঠমিস্ত্রি স্বামীর সংসারের ভার লাঘব করতে পেরেছেন সাগরী রানী। ছোট্ট এক বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন। এখন নিজেদের রোজগারে গড়া চমৎকার বাড়িতে থাকেন তাঁরা।
উৎসবের মৌসুমে গয়নার ফরমাশ বেশি আসে। যত রকম গয়না গড়া যায়, সবই এখানে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব জেলার পাইকারেরা এখান থেকে গয়না নেন। রাজধানীর নামীদামি শপিং কমপ্লেক্সের বেশির ভাগ গয়নাই এখান থেকে যায়। বেশির ভাগ সময় নিজেদের ভাবনা থেকেই এখানকার গ্রামবাসীরা গয়নার নকশা উদ্ভাবন করেন। অনেক সময় আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কোনো গয়নার নকশার ধারাও অনুসরণ করেন। তৈরি এসব গয়না খুচরাও বিক্রি হয়। ব্যক্তিগতভাবে ফরমাশ দিয়ে পছন্দের নকশার গয়না গড়িয়ে নেওয়ার সুযোগও রয়েছে।
ভাকুর্তায় এমন বহু মানুষ রয়েছেন, বংশপরম্পরায় যাঁরা গয়নাশিল্পের সঙ্গেই যুক্ত। এই কাজ করে ঘুরিয়েছেন নিজেদের ভাগ্যের চাকা। বংশপরম্পরায় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনধারণের মাধ্যম হিসেবে এই শিল্পকেই বেছে নিয়েছেন। লোকমুখে এই এলাকার নামই হয়ে গেছে গয়না গ্রাম। বাড়িতে বাড়িতে গয়নার কাজ হওয়ার পর চলে যায় স্থানীয় দোকানে। গয়না তৈরির পরবর্তী ধাপগুলো চলে সেখানেই।
গয়না গ্রাম ঘুরে দেখতে পেলাম, দোকানে দোকানে কাজ করছেন কারিগরেরা। সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সাদামাটা ধাতব উপাদানেই ফুটিয়ে তুলছেন চমৎকার সব নকশা। ভারত আর চীন থেকে আসা তামা ও পিতল থেকে গড়া হয় বাহারি নকশার গয়না। প্রাথমিক গড়নের পর ঝালাই করা হয়। নকশার ধারা অনুযায়ী মানানসই পাথর বা পুঁতি বসিয়ে দেওয়া হয়, মিনা করা হয়। ঝকমকে গয়না গড়তে প্লেটিংও করতে হয়।
দোকানগুলোর মালিকেরা আর কারিগরেরাও জানান, বহুদিন ধরে তাঁরা গয়নাশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কেউ ১০ বছর, কেউ ১৫, কেউ আবার মহাদেব রাজবংশী কিংবা পরেশচন্দ্র সরকারের মতো ২০ বছরের অধিক সময় ধরে কাজ করছেন। দাদা ও বাবার পর ব্যবসায় হাল ধরে অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়ার গল্প শোনান মইনুল ইসলাম ও আলাউদ্দীন। পৌনে তিন লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে গয়নার ব্যবসা শুরু করেন তাঁরা। আর গয়নার নকশা তৈরি করেই বানিয়েছেন কোটি টাকার সম্পদ। সে জন্য অবশ্য দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁদের। কারিগরদের বাড়ি বাড়িও যেতে হয়েছে।
এসব দোকানে নানা ধরনের গয়না পাওয়া গেলেও রিপন হাওলাদার কেবল কঙ্কণ বালা গড়েন। আগে সোনার গয়নার কাজ করতেন, এরপর রুপা। চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন তামা আর পিতলের গয়নাই গড়েন তিনি। তাঁর দোকানের বিশেষত্বই হলো কঙ্কণ বালা। গয়না তৈরিতে প্রয়োজন হয় নানা উপকরণ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কারিগরদের হাতের জাদু। যে জাদুতে ফুটে ওঠে অনিন্দ্য সব নকশা। তবে ভাকুর্তা বাজার ঘুরে জানা গেল, সাম্প্রতিক সময়ে গয়নার বাজারে খানিকটা মন্দা যাচ্ছে। তামা, পিতলের পাশাপাশি ছোট পরিসরে রুপার ব্যবসা টিকে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে রুপা আনা-নেওয়ার সময় আইনি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে বলে জানান এক দোকানমালিক।