জিআই যোদ্ধা তাঁরা: কী করেন, কীভাবে করেন
এক দশকে বাংলাদেশের ২১টি পণ্য পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। যার মধ্যে শুধু গত বছরেই মিলেছে ১০টির স্বীকৃতি। আর এই স্বীকৃতি আদায়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সংগঠন ইডিসি। কিন্তু জিআই স্বীকৃতির মতো সরকারি কাজে স্বাধীন উদ্যোক্তারা কীভাবে অবদান রাখলেন? তরুণ উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সেই গল্পই শুনলেন পার্থ শঙ্কর সাহা
২০২০ সাল থেকে একসঙ্গে কাজ করছেন ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের (ইডিসি) সদস্যরা। এটি অনলাইনে ভিন্ন ভিন্ন পণ্য নিয়ে ব্যবসা করা উদ্যোক্তাদের ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম। যাঁদের কেউ জামদানি শাড়ির প্রসারে কাজ করেন। কেউ ব্যস্ত শেরপুর জেলার বিখ্যাত তুলসীমালা চালের বিপণন নিয়ে। দেশীয় গয়না, টাঙ্গাইলের স্বল্প পরিচিত ‘খেশ শাড়ি’ কিংবা যশোরের হস্তশিল্পের প্রসার ও বিক্রিতে জড়িত আছেন কেউ কেউ। পণ্যের ভিন্নতা থাকলেও তাঁদের কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন সবাই কাজ করেন দেশি পণ্য নিয়ে। আবার তাঁরা বেশির ভাগই নারী। পণ্য বিক্রির পাশাপাশি অন্য নানা বিষয়েই তাঁরা এককাট্টা। সেই সাহসেই প্রস্তাবটা দেন ময়মনসিংহের উদ্যোক্তা খাতুন এ জান্নাত। জিআই স্বীকৃতির জন্য পণ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং নথিবদ্ধ করার কাজটা নাহয় আমরাই করি, এই ছিল তাঁর প্রস্তাব। অন্য সদস্যরা সবাই একমত হলেন।
পণ্য জিআই করার আগে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই স্বীকৃতি দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। আর যে জেলার পণ্য জিআই হবে, তার জেলা প্রশাসক বা সরকারি কোনো দপ্তরকে আবেদন করতে হয়। কিন্তু দেখা গেছে, পণ্যের তালিকা করেও দীর্ঘ সময় ধরে এসব জেলা বা সরকারি কর্তৃপক্ষ ওই পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়নি। পণ্য জিআই হতে গেলে পণ্যের অন্তত ৫০ বছরের ঐতিহ্য থাকতে হয়, যে এলাকার পণ্য তার স্বীকৃতি থাকতে হয়। ঐতিহাসিক দলিল–দস্তাবেজই শুধু নয়, প্রাচীন সাহিত্য-পুঁথি-ছড়ায় কোনো উল্লেখ থাকলেও প্রমাণ হিসেবে তা তুলে ধরা হয়। এসব খুঁজে বের করা গবেষণার বিষয়।
জিআই কেন গুরুত্বপূর্ণ: দিন যত যাচ্ছে, বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে তত বাড়ছে পণ্যের স্বত্বের গুরুত্ব। এ কারণেই জিআই নিয়ে এত তোড়জোড়। কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর কোনো সংস্কৃতি যদি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেই পণ্যটি ওই অঞ্চলের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০১২ সালের দিকে জামদানি শাড়ি, আম ও ইলিশকে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় ভারত। অথচ এসব পণ্য বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু পণ্য জিআই করার জন্য দেশে তখন কোনো আইন ছিল না। বেশ দ্রুততার সঙ্গে ২০১৩ সালে সেই আইন হলো। আর প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত হলো জামদানি। বাংলাদেশের পণ্য হিসেবেই নথিভুক্ত হলো এই শাড়ি। ভারতও জামদানিকে জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত করল, তবে ‘উপাধা জামদানি’ নামে। বাংলাদেশে এরপর একে একে স্বীকৃতি পায় ইলিশ, ক্ষীরশাপাত আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম। আর সম্প্রতি জিআই স্বীকৃতি পেল টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা এবং ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল।
সেই কাজটিই করতে শুরু করলেন ইডিসির সদস্যরা। গত বছরের শুরুতেই গঠন করা হয় ৩০–৩৫ জনের একটি দল। তারা আবার ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যায়। কারও কাজ তথ্য সংগ্রহ, কারও দায়িত্ব বইপত্র ঘাঁটা, কারও সরাসরি পরিদর্শন, কারও ছবি তোলা। আর এ কাজেও তাদের মাধ্যম হলো ফেসবুক। পণ্য ধরে ধরে সামাজিক এই মাধ্যমে তথ্য চাইলেন উদ্যোক্তারা। এসব পণ্য সম্পর্কে নিজেদের জানা তথ্য সেখানে দিতে থাকল সাধারণ মানুষ। এসব তথ্য নথিবদ্ধ করা হলো। খাতুন এ জান্নাত বলছিলেন, ‘কোনো পণ্য জিআই হলে আখেরে আমাদের দেশেরই লাভ। কারণ, পণ্য জিআই হলে তা বিশেষ পণ্যে পরিণত হয়। আমরা তাই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজটা করে যেতে থাকলাম।’
আর ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে শুরু হলো এলাকা সফর। কারও কোনো সহায়তা নেই, নিজেদের গাঁটের পয়সায় চলত বিভিন্ন জেলায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ। ইডিসির চেয়ারম্যান কাকলী তালুকদার বলছিলেন, ‘নরসিংদীতে আমার বাড়ি। সেখানে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সবাই আমার বাসাতেই ছিলেন।’
বাংলাদেশের ৫০ বছরের অগ্রগতির যে গল্প, সে গল্প রচনা করেছেন ইডিসির এই তরুণদের মতো নাম না-জানা নানা মানুষ। কোনো প্রতিষ্ঠানের দিকে না তাকিয়ে নিজস্ব উদ্যোগে দেশের উন্নয়নের নানা উদ্যোগে শামিল হয়েছেন তাঁরা। আমাদের দেশে মধ্যম অর্থনীতি নিয়ে খুব কম কথা হয়, কাজ হয় আরও কম। পারিবারিক বা রাষ্ট্রীয় অবস্থাই সেখানে আলোচ্য। অথচ এর বাইরে মধ্যম অর্থনীতির বিশাল ভূমিকা আছে। এই তরুণেরা স্থানীয় বা জেলার অর্থনীতি নিয়ে কাজ করছেন। মধ্যম অর্থনীতি নিয়ে এমন উদ্যোগ আমি দেখি না। তাঁদের এ কাজ আমাকে বিস্মিত করেছে। কর্মীদের অনেকেই শিক্ষার্থী। কোনো লাভের চিন্তা না করে একদল তরুণের এ প্রয়াস অভিনব। বাংলাদেশ এমন তরুণদের নিয়ে আশাবাদী হতে পারে।
তথ্য সংগ্রহের পথ মসৃণ ছিল না। জেলা প্রশাসন তাদের চেনে না। কোথাও কোথাও তথ্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অভিজ্ঞতাও হয়েছে, জানালেন দেলোয়ার হোসেন নামের এক উদ্যোক্তা। জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী দেলোয়ার বলছিলেন, ‘তারপরও আমরা থেমে থাকিনি। কাজ চালিয়ে গেছি। অনেকে সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
এভাবে কাজ করতে গিয়েই এই উদ্যোক্তারা পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) কর্মকর্তা জিল্লুর রহমানের দ্বারস্থ হন। তিনি এই তরুণদের উৎসাহ দেখে পণ্যের তথ্য সংগ্রহের কাজে তাঁদের কাজে লাগাতে রাজি হন। এবার পথটা অনেকটা সহজ হলো।
তথ্য সংগ্রহের পর তা জেলা প্রশাসন বা সরকারের আবেদনকারী কর্তৃপক্ষকে জমা দেন উদ্যোক্তারা। জেলা প্রশাসন সেগুলো ডিপিডিটিতে পৌঁছে দেয়। তারা কোনো সংশোধনী আনলে সেগুলোও ঠিকঠাক করে দেন এই উদ্যোক্তারা। এভাবে চলছে তাঁদের কাজ।
এ পর্যন্ত ১৭টি জেলা সফর করেছেন এই উদ্যোক্তারা। করে ফেলেছেন ৩০টি পণ্যের সব কাজ। এর মধ্যে গত বছরই ১০ পণ্যের জিআই হয়ে গেছে।
একটি পণ্য জিআই তালিকাভুক্ত করতে দীর্ঘ গবেষণা দরকার। নিষ্ঠা নিয়ে এ কাজ করতে হয়। আর এ কাজে বড় ভূমিকা নিয়েছে ইডিসি। এ সংগঠনের সদস্যরা আমাকে বলেছেন, তাঁরা কোনো অর্থ চান না। সরকারি কোনো কাজ তাঁরা ন্যূনতম প্রভাবিত করতে চান না। ইডিসির কর্মীরা যেমনভাবে কাজ করেছেন, তেমন নিষ্ঠা সত্যিই বিরল। নিজেদের অর্থে জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কঠোর পরিশ্রম করেছেন। যাঁরা এ কাজের সঙ্গে আছেন, তাঁদের সবাই বয়সে নবীন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের নানা অভিযোগ আছে। সেখানে তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সর্বোত্তম ব্যবহার করেছেন। একদল তরুণের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এই প্রয়াস শিক্ষণীয়।
৫০০ পণ্যকে জিআইভুক্ত করতে চান তাঁরা
ইডিসির সদস্যরা সবাই দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু দেশে যে এত পণ্য আছে, রপ্তানি পণ্য হিসেবে সেগুলোর যে ভূমিকা আছে, অনেক ক্ষেত্রেই তা বিবেচিত হয় না। শুধু বিদেশই–বা কেন। দেশের এক অঞ্চলের পণ্য অন্য অঞ্চলে গেলেও পণ্যের পসার বাড়ে। সেখানে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে জিআই। উম্মে শাহেরা নামের এক উদ্যোক্তা বলছিলেন, ‘স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অনেকে জিআইয়ের গুরুত্বটা বোঝেন না। তাঁদের বোঝানোর কাজটাও আমাদের করতে হয়। জিআই যে পণ্যের মর্যাদা বাড়ায়, অনেকেই এখন সেটা উপলব্ধি করছেন। এটা তো শেষবেলায় স্থানীয় অর্থনীতির মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়।’
ফেসবুকে উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্মটি গড়ার নেপথ্যে আছেন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি রাজীব আহমেদ। তিনি বলছিলেন, ‘পণ্য জিআই হলে একটি সাধারণ পণ্য অসাধারণ হয়ে যায়।’ এ জন্যই আরও নতুন নতুন পণ্যের খোঁজে ব্যস্ত তরুণ ‘সাধারণ’ উদ্যোক্তারা। অন্তত ৫০০ পণ্যকে জিআইভুক্ত করতে চান তাঁরা।