ফুটবল উৎসবের চেয়ে বেশি কিছু
বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফুটবলের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে ইস্পাহানি ও প্রথম আলো দারুণ এক উদ্যোগ নিয়েছিল গত বছর। ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রথমবার হয়েছিল আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট। দ্বিতীয় টুর্নামেন্টে দল বেড়ে হয়েছে ৪২, অঞ্চল তিন থেকে বেড়ে হয়েছে চার। আনন্দময় এই আয়োজনের পর্দা নেমেছে ৯ ডিসেম্বর।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে এটি এখন নিজেদের টুর্নামেন্ট। দলগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং কেউ কাউকে ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। ৪ অঞ্চলে ১৫ দিনে ৪১টি ম্যাচের প্রচার-প্রচারণায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ বেড়েছে ফুটবল নিয়ে। কে কার বিপক্ষে খেলছে, কোন দলে কোন খেলোয়াড়—এসবও হয়ে উঠেছে আলোচনার বিষয়। সবকিছুর যোগফল—এটি শুধুই ফুটবল উৎসব নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু।
চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীতে খেলা হয়েছে স্থানীয় স্টেডিয়ামে। ঢাকায় কোনো স্টেডিয়াম নয়, উন্মুক্ত মাঠে। দলগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, কিন্তু কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। ঘটেনি কোনো অঘটনও। গতবার পুরো টুর্নামেন্টে একজন খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখেছেন। এবার ৪১ ম্যাচই লালকার্ডশূন্য। খেলা পরিচালনা করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় রেফারিরা। তাঁদের সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে দেখা যায়নি কোনো বিতর্ক। খেলোয়াড় নিয়েও আসেনি তেমন কোনো অভিযোগ।
মাঠ-মুগ্ধতা
ইস্পাহানি-প্রথম আলো আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলের দুটি আসরের ঢাকা ও চূড়ান্ত পর্ব হয়েছে সাভারের বিরুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে। ছায়াঘেরা মনোরম ক্যাম্পাসের পরিবেশ মুগ্ধ করার মতো। ২২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ১৮০ একরজুড়ে। মাঝখানে সবুজ গালিচার মতো বিছানো মাঠটা দেখে মুগ্ধ হবেন যে কেউ। রক্ষণাবেক্ষণের কল্যাণে মাঠটি আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠেছে।
প্রথমবার সকাল থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনটি ম্যাচ, কোনো কোনো দিন চারটিও হয়েছে। এবার সর্বোচ্চ তিনটি ম্যাচ হয়েছে গ্রুপ পর্বে। মাঠটি এতই ফুটবল উপযোগী যে প্রশংসা ঝরেছে সবার মুখেই। দেশের সর্বোচ্চ প্রিমিয়ার লিগ যেখানে এবড়োখেবড়ো মাঠে হচ্ছে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল এমন মাঠে হওয়া দারুণ প্রাপ্তি বটে।
ড্যাফোডিলের ক্যাম্পাসে অন্য সব সুযোগ-সুবিধাও আছে। এবারও ঢাকার বাইরে দলগুলো চূড়ান্ত পর্বে খেলতে ড্যাফোডিলের ক্যাম্পের হোস্টেলে উঠেছে। কোনো কিছু নিয়ে কারও অভিযোগ ছিল না। প্রতিষ্ঠানটি সাংগঠনিক কাঠামো বেশ শক্তিশালী। বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যে ড্যাফোডিলই প্রথম শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগে খুলেছে। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক (গেমস অ্যান্ড স্পোর্টস) সাদ আন্দালিব জানান, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগ খোলায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের খেলাধুলায় ড্যাফোডিল এখন বড় নাম।
তারকার উপস্থিতি
ঢাকা পর্বে একটানা মাঠে উপস্থিত থেকে সব কটি খেলা দেখার অভিজ্ঞতায় বলতে দ্বিধা নেই, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দল অনায়াসে দেশের দ্বিতীয় সারির কোনো ক্লাবের সঙ্গে লড়তে পারে। টুর্নামেন্টটি তাই ‘শুধু আনন্দে খেলা’ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। জমে উঠেছে তুমুল প্রতিযোগিতা। একটা ‘ফুটবল বাহিনী’ হিসেবে তৈরি হয়ে গেছে ড্যাফোডিল, এআইইউবি, গণ বিশ্ববিদ্যালয় বা ফারইস্টের মতো দলগুলো। ড্যাফোডিলের জার্সিতে আলো ছড়ান জাতীয় দলের ডিফেন্ডার রহমত মিয়া ও ঈসা ফয়সাল। ড্যাফোডিলের ২২ জনের স্কোয়াডের দু-একজন বাদে বাকিরা দেশের শীর্ষস্থানীয় ফুটবলার। গণ বিশ্ববিদ্যালয়, এআইইউবি, ফারইস্টও তাই।
ফারইস্টের জার্সিতে খেলেছেন জাতীয় দলের মিডফিল্ডার মোহাম্মদ হৃদয়, ডিফেন্ডার ইয়াছিন আরাফাত। এআইইউবির জার্সিতে দেখা গেছে আশির দশকের অন্যতম সেরা ফুটবলার খন্দকার ওয়াসিম ইকবালের ছেলে নাবিল খন্দকারকে। টুর্নামেন্ট নকআউট হওয়ায় ব্যবধান কমে এসেছে দলগুলোর মধ্যে। গতবারের চ্যাম্পিয়ন গণ বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার ফাইনালে সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে পারেনি, তাতেই বিদায় নিতে হয়েছে।
রাজশাহীর চমক
গণ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদায় দিয়ে বড় চমক দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। যে দলে ছিলেন না দেশের শীর্ষস্থানীয় কোনো ফুটবলার। কিন্তু খেলেছে ‘বড় দলের’ মতোই। গ্রুপ পর্বেই দেখিয়েছে বিরাট ঝলক। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে ৬ গোল, আর গ্রুপ ফাইনালে ১৬ গোল দিয়েছে আহ্ছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে। ঢাকায় এসে কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় দিয়েছে গতবারের চ্যাম্পিয়ন গণ বিশ্ববিদ্যালয়কে ( ২-১)। তবে সেমিফাইনালে পেরে ওঠেনি রানার্সআপ ফারইস্টের সঙ্গে।
ভালো করতে না পারা দলগুলোর কোচ-কর্মকর্তারা ভবিষ্যতে শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে আসার প্রত্যয় জানিয়েছেন। খেলোয়াড় কোটায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ফুটবলারদের ভর্তি করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভবিষ্যতে খেলতে চায়। কয়েকটি দলের কোচ-খেলোয়াড়েরা এমন কথাই বলেছেন। বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির কোচ, ২০০৩ সালে সাফজয়ী ফুটবলার রোকনুজ্জামান কাঞ্চন যেমন বলেন, ‘আমরা জাতীয় পর্যায়ের দু-তিনজন খেলোয়াড় নিতে পারলে ভবিষ্যতে শক্তিশালীভাবে
ফিরে আসব।’
দর্শক জোয়ার
প্রথমবার ফাইনাল গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে। এবার ফাইনাল শেষ হয়েছে নির্ধারিত ৭০ মিনিটেই। তবে দর্শক সমাগম ছাপিয়ে গেছে গতবারের ফাইনালকে। স্বাগতিক দল ফাইনালে ওঠায় মাঠের আশপাশে সব উঁচু ভবনের ছাদ, ব্যালকনি ভরে গিয়েছিল। মাঠের চারপাশে উপস্থিতি ছিল বিপুল। ড্যাফোডিলের গোলের পর স্রোতের মতো শিক্ষার্থীরা মাঠে ঢুকে পড়েন। এতে খেলা কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছে। তবে ম্যাচ শেষ হয়েছে ভালোয় ভালোয়। ফাইনাল ম্যাচকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলের এল ক্লাসিকো’ হিসেবে বর্ণনা করছিলেন এক শিক্ষার্থী।
এত দর্শক দেখে খুশি ড্যাফোডিলের সার্বক্ষণিক মাঠে থাকা পৃষ্ঠপোষক ইস্পাহানির কর্মকর্তারা। গোটা আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাবেক জাতীয় ফুটবলাররাও খুশি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো সাবেক খেলা দেখতে ড্যাফোডিলে গেছেন। তাঁদের অন্যতম টুর্নামেন্ট কমিটির প্রধান ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলছিলেন, ‘এত সফল ও জমজমাট আয়োজন সত্যিই নতুনভাবে আশা দেখায়। ভবিষ্যতে আন্তকলেজ ও আন্তস্কুল টুর্নামেন্ট হলে দেশের ফুটবলের চেহারা বদলে যাবে।’
টুর্নামেন্ট কমিটির সদস্য ও জাতীয় দলের সাবেক কোচ শফিকুল ইসলাম মানিকের চোখে এবারের আয়োজন ছিল ব্যতিক্রম। তাঁর কথায়, ‘খেলোয়াড়দের অনেকে প্রিমিয়ার লিগে খেলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁদের ভালো বন্ধন আছে। ক্লাবের খেলা ছেড়েও তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্সিতে খেলেছেন। এটা খুব ভালো লেগেছে।’
অতিথিদের এই ভালো লাগাই টুর্নামেন্টের সার্থকতা। আগামী বছর আরও বড় পরিসরে আয়োজনের অনুপ্রেরণাও।