একসঙ্গে জীবনটাকে আলিঙ্গন করতে চান আশিস-রুপালি দম্পতি
ভারতের ফিল্মি দুনিয়ার চেনা মুখ আশিস বিদ্যার্থী। বাংলাদেশের সঙ্গেও রয়েছে তাঁর নানা যোগ। ঢাকায় এসেছেন দুবার, বাংলাও বলতে পারেন চমৎকার। সম্প্রতি আজমেরী হক বাঁধন অভিনীত খুফিয়া চলচ্চিত্রেও তাঁকে দেখা গেছে। তবে অভিনয় নয়, ৫৭ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করে মাসছয়েক আগে আলোচনায় আসেন এই অভিনেতা। এই বিয়ে, বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাঁর ছুটে চলা, জীবনযাপন, ঘোরাঘুরি, ভ্লগিং নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে ‘অধুনা’।
তাঁর কাছে দাম্পত্যসঙ্গী মানে ঘুরে বেড়ানোর জন্য একজন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। যাঁর সঙ্গে সূর্যোদয় দেখার জন্য খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করে। যাঁর সঙ্গে ব্রিজের পাশের টংঘর থেকে চা আর মশার কামড় খেতে খেতে মনে হয়, জীবনটা মন্দ নয়। যাঁর সঙ্গে ব্যথা ভাগ করার পর হঠাৎ খেয়াল হয়, ব্যথাটা তো আর আগের মতো লাগছে না। যাঁর সঙ্গে দিনের পর দিন গল্প করতে করতে খাবার ভাগ করে খাওয়া যায়। ছয় মাস হলো, সেই রকম একজন মানুষকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গেই ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন ‘ফিফটি প্লাস জিন্দেগি’। আমাদের আজকের এই লেখার নায়ক বড় পর্দার ‘খলনায়ক’, ভারতের ফিল্মি জগতের চেনা মুখ আশিস বিদ্যার্থী। মাস ছয়েক আগে সারা ভারতেই যাঁকে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে সেই আওয়াজ বাংলাদেশে এসেও পৌঁছেছিল। ৫৭ বসন্ত পেরিয়ে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে রীতিমতো একটা ‘হট টপিক’ হয়ে দাঁড়াল। বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রতিদিন তিনি যেভাবে ছুটে চলেছেন, জীবনকে উপভোগ করে বেঁচে আছেন, যেকোনো তরুণকেই তা হার মানাবে। হোয়াটসঅ্যাপে লম্বা কথোপকথনে উঠে এল নানান গল্প।
বিয়ে নিয়ে হট্টগোল
আশিস বিদ্যার্থীর বিয়ে নিয়ে যতটা চর্চা হয়েছে, বলিউডের প্রথম সারির তারকাদের সঙ্গে পাল্লায়ও হারিয়ে দেওয়ার জন্য সেটি যথেষ্ট। এত আলোচনার পেছনে মূল কারণ দুটি। এক. তিনি আবার বিয়ে করেছেন ৫৭ বছর বয়সে।
দুই. সবাই জানতেন, তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী রাজশী বড়ুয়ার সঙ্গে সংসার করছেন। এই জুটি যে ২০২২ সালের অক্টোবরে পাকাপাকি আলাদা হয়ে গেছেন এবং এর আগের দুই বছর আলাদা থাকছিলেন, গণমাধ্যমের সে কথা জানা ছিল না। তাই আলোচনার একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল সমালোচনা। এক পক্ষ বলছিল, তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ‘প্রতারণা’ করেছেন। আরেক পক্ষ কেন তিনি ‘এত বয়সে’ এসে আবার বিয়ে করলেন, সেটিই হজম করতে পারছিল না। ঢাল হয়ে প্রথমে এগিয়ে আসেন প্রথম স্ত্রী।
গণমাধ্যমকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, কেউ তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেননি। তাঁদের দুজনের মতের মিল হচ্ছিল না। তিনি এ–ও বলেন, বহুদিন তিনি শকুন্তলা বড়ুয়ার কন্যা হয়ে বেঁচেছেন। বিয়ের পর ২২ বছর আশিস বিদ্যার্থীর স্ত্রী হয়ে বেঁচেছেন। বাকি জীবনটা নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চান। সাবেক জীবনসঙ্গীকে নতুন জীবনের জন্য অভিনন্দনও জানান এই গায়িকা ও অভিনেত্রী।
এদিকে আশিস বিদ্যার্থী প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, বিয়ে করা কি অন্যায়? নাকি বয়স হয়ে গেছে বলে ভালোভাবে বাঁচতে চাওয়াটা অপরাধ?
দুজন নিঃসঙ্গ মানুষ
জীবনের একটি মন খারাপ করা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন আশিস বিদ্যার্থী। স্ত্রী থেকে আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্কের টেসলা কোম্পানিতে নিজের চাকরি নিয়ে ব্যস্ত একমাত্র পুত্র মোগলি আর্থ। শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিজের অগোচরে আশিস যেন তাই খুঁজে ফিরছিলেন একজন সঙ্গী। যাঁকে পাশে নিয়ে বাকি জীবন হাঁটবেন, ঘুরে বেড়াবেন, গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশ থেকে খাবেন আর ভ্লগ বানাবেন। রুপালি বড়ুয়ার সঙ্গে যেদিন আলাপ হলো, অপেক্ষার যেন অবসান হলো।
রুপালির চিকিৎসক স্বামী মারা গিয়েছিলেন আরও বছর পাঁচেক আগে। এর পরপরই যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন তাঁর একমাত্র কন্যা। ব্যক্তিগত দুঃখগুলো যত্ন করে নিজের ভেতরে ঝিনুকের মতো মুক্তা বানিয়ে আনমনে হেঁটে চলছিলেন জীবনের পথে। এর মধ্যেই হঠাৎ আশীষের সঙ্গে পরিচয়। প্রথম দেখায় কেমন লেগেছিল? রুপালি বলেন, ‘বড় পর্দায় তো দেখেছিলাম। জানতাম, পর্দার চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের রক্তমাংসের মানুষকে মেলানো যায় না। প্রথম যখন আমার ফ্যাশন হাউসের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে গল্প করছিলাম, মনে হলো মানুষটা খুবই হৃদয়বান আর অমায়িক।’
কখন মনে হলো, রুপালি নামের এই মানুষটাকেই আপনি মনে মনে খুঁজছিলেন? আশিস বললেন, ‘ওভাবে কি বলা যায়? কেমন জীবনসঙ্গী চান, এই প্রশ্নের আসলে কোনো উত্তর হয় না। কেবল হৃদয় জানিয়ে দেয়, জেদ করে যে এই মানুষটাকে ছাড়া তার আর চলবে না। আমার ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে। জাস্ট মনে হলো, ওর কাছে পৌঁছেই আমার খোঁজ ফুরিয়েছে।’ ভারতের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া, ১১টি ভাষার সিনেমায় অভিনয় করা এই তারকা আরও বললেন, ‘জীবনের কাছে দুজন মানুষের মূল চাওয়াটা যখন মিলে যায়, তখন অন্য সবকিছু মানিয়ে নিয়ে পথ চলা যায়। ওর সঙ্গে অনেক গল্পের পর বুঝলাম, আমরা এক পথ দিয়ে বহুদূর হেঁটে যেতে পারি। আমি ওকে কখনো বলিনি ভালোবাসি, সরাসরি জানতে চেয়েছি, তোমার কি বিয়ের পরিকল্পনা আছে? কেননা, আমি বিয়েতে প্রবল বিশ্বাসী। আর ঘুরে বেড়ানোর জন্য আমি একজন সঙ্গী খুঁজছিলাম।’
ফিফটি প্লাস জিন্দেগি
দুজন পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষ ছয় মাস ধরে ভারতের এ–প্রান্ত থেকে ও–প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই তো গত বৃহস্পতিবার গোয়াহাটিতে লংড্রাইভ শেষে ফিরছিলেন তাঁরা। সন্ধ্যায় রাস্তায় দেখেন, কয়েকজন নারী রঙিন শাড়ি পরে সেজেগুজে হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁরা কোত্থেকে এসেছেন, কোথায়বা যাচ্ছেন, কে জানে! নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন তাঁরা, আর মাঝেমধ্যে হেসে উঠছেন। এ রকম হাসিমুখই আশীষের প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে সুন্দর একটি কর্মব্যস্ত দিন শুরুর অনুপ্রেরণা।
ছোটবেলা থেকেই ঘুরে বেড়াতে খুব ভালোবাসেন তিনি। সুখী মানুষের চোখের দীপ্তি তাঁকে ভেতর থেকে আলোকিত করে। নানা প্রান্তে গিয়ে নিঃশব্দে কান পাতেন আশিস। আবারও বেরিয়ে পড়েন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষের সঙ্গে গল্প করেন, মাঝেমধ্যেই তাঁদের জীবন থেকে কুড়িয়ে নেন বেঁচে থাকার একেকটি ট্রাম্পকার্ড।
ইউটিউবে আশিস বিদ্যার্থীর পেজে চোখ রাখছে ১৭ লাখ অ্যাকাউন্ট। এ ছাড়া ‘ফিফটি প্লাস জিন্দেগি’ নাম দিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব দুই ‘তরুণ-তরুণী’ প্রতিনিয়ত যেভাবে জীবনকে নিংড়ে তাঁর রস আস্বাদন করছেন, সেসব ভাগ করে নিচ্ছেন অন্যদের সঙ্গে। এ ছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেন এই অভিনেতা কাম ইউটিউবার। সেটি শুনতে পাওয়া যাবে আশিস বিদ্যার্থী পডকাস্টে।
কেন ফিফটি প্লাস জিন্দেগি? উত্তরের প্রথম অংশটা শুনুন রুপালির কাছ থেকে, ‘জীবন শুরুর জন্য বয়স কোনো বিষয় নয়। যেকোনো সময় থেকে আপনি জীবন শুরু করতে পারেন।’ সঙ্গে আশিস যোগ করলেন, ‘ফিফটির জায়গায় থার্টিও হতে পারে, আবার এইটিও হতে পারে—বয়স যা-ই হোক না কেন, তাঁর সঙ্গে জীবনটাকে জুড়ে দিন। এ জন্যই প্লাস জিন্দেগি। আমরা দুজনেই বয়সে হাফ সেঞ্চুরি করেছি। তাই ফিফটি প্লাস জিন্দেগি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দুজনে একসঙ্গে প্রতিদিন জীবনটাকে আলিঙ্গন করতে চাই। রুপালি আমার জীবন আলিঙ্গনের সঙ্গী।’ শেষ প্রশ্নটা যেমন দুজনে মিলে সম্পূর্ণ করলেন, একইভাবে এই দুজন ৫০ বসন্ত পরে হলেও দুজনের জীবনে এসে দুটি জীবনকে পূর্ণতা দিচ্ছেন!