মশা তাড়ানোর যেই চমকপ্রদ আবিষ্কারের পেছনে বিনিয়োগ করছেন বিল গেটস
তিনি মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা। একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষ হিসেবেও লোকে তাঁকে চিনত। তবে নিজেকে এখন মানবহিতৈষী হিসেবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন বিল গেটস। তাই তো মানুষের জন্য কল্যাণকর আবিষ্কারের পেছনে বিনিয়োগ করতে চেষ্টা করেন তিনি। সম্প্রতি এমনই এক বিনিয়োগের পেছনের গল্প লিখেছেন নিজস্ব ব্লগ লেখার ওয়েবসাইট—গেটসনোটসে।
আপনি কি মশা–আকর্ষক? মশার কামড়ের পক্ষপাতহীন ভাগ যদি আপনার কাছে না পৌঁছায়, তাহলে অনুমান করতে পারি, আপনার কাছের কারও কাছে নিশ্চয়ই পৌঁছে যাচ্ছে। কেননা কিছু কিছু মানুষ মশাকে একটু বেশিই আকর্ষণ করে।
এর কারণ সম্ভবত গায়ের ঘ্রাণ। গন্ধের ওপর নির্ভর করে মশা তার শিকার ঠিক করে। কিছু কিছু ঘ্রাণ মশাকে আকর্ষণ করে, যা জৈবিক নিয়মেই মানুষের শরীরে তৈরি হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে মশার কাছে আমাদের ঘ্রাণ সুস্বাদু খাবারের মতো। শরীরে বা কাপড়ে কিছু নির্দিষ্ট স্প্রে ব্যবহার করে আপনি হয়তো কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবেন, কিন্তু টেকসই সুরক্ষা চাইলে আপনার দৈনন্দিন রুটিনে আরও কিছু পদক্ষেপ যোগ করতে হবে। অনেকেরই হয়তো এত কিছু করার সময় নেই।
তবে একটা সুখবরও শুনতে পাচ্ছি। ডিএসএম-ফার্মেনিক নামে এক প্রতিষ্ঠান নাকি মশাকে দূরে রাখার উপায় বের করেছে, যা একদম সহজ।
২০১৬ সালে আমি ডিএসএম-ফার্মেনিকের গবেষণাগারে গিয়েছিলাম। সে সময় দরিদ্রদের জন্য উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে টয়লেটের দুর্গন্ধ দূর করা নিয়ে কার্যক্রম চলছিল। পুষ্টি, রূপচর্চা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের অন্যতম বড় সুগন্ধি উৎপাদক। তাদের তৈরি বেশির ভাগ সুগন্ধিই মূলত আমাদের খাবারের স্বাদ বাড়াতে বা বিভিন্ন পণ্যে সুঘ্রাণ যোগ করতে ব্যবহৃত হয়। তবে রোগ সংক্রমণ রোধেও এই দক্ষতা তারা ব্যবহার করে। সম্প্রতি মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করতে শুরু করেছে।
লক্ষ্যটা সহজ: দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্যের সঙ্গে এমন গন্ধ জুড়ে দেওয়া, যা মশাকে দূরে রাখবে। বিস্তর গবেষণার পর তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সাবান ও কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট নিয়ে প্রাথমিক কাজ হবে। (বডি লোশন ও বডি ক্রিম নিয়েও তারা ভাবছে।) এসব পণ্যে এমনিতেও সুগন্ধ থাকে। সেই ঘ্রাণ যদি মশাকেও দূরে রাখতে সাহায্য করে, তাহলে কেমন হয়?
অর্থাৎ বাড়তি কষ্ট না করে, বাড়তি পণ্য না কিনেও আপনি মশা থেকে সুরক্ষা পেতে পারবেন। ডিএসএম-ফার্মেনিকের কেউই দাবি করছেন না, এতে রাতারাতি কোনো জাদুকরি পরিবর্তন আসবে। তবে মশারির মতো পণ্যে যদি এই ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা যায়, তাহলে হয়তো ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর হার কমবে।
মশা থেকে দিনব্যাপী সুরক্ষা দেবে, এমন একটি সাবান তৈরির কাজটা বেশ জটিল। জেনেভার বিজ্ঞানীরা আপাতত এমন সব সুগন্ধি উপাদান খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছেন, যা মশা দূরে রাখে, আবার পারফিউম তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। এই উপাদানগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি সত্যিই এমন, যা মশার একদমই পছন্দ হবে না। আবার কোনো কোনো উপাদান এমনভাবে কাজ করে, যেন মশার মস্তিষ্কে ঘ্রাণের খবরটা না পৌঁছায়।
যেহেতু এর সঙ্গে নতুন সুগন্ধি তৈরিও জড়িত, তাই মানুষের গ্রহণযোগ্যতাও এখানে বড় ব্যাপার। শুধু কার্যকর হলেই তো হবে না, ঘ্রাণটা পরিচ্ছন্ন ও তাজা হতে হবে। আমার যেমন চিজ বার্গারের ঘ্রাণ ভালো লাগে। তাই বলে মশা থেকে বাঁচতে আমি নিশ্চয়ই চিজ বার্গারের গন্ধযুক্ত পোশাক পরতে রাজি হব না!
কোন সুগন্ধিটা কাজের, সেটা যাচাই করার জন্য গবেষকেরা এখন একটা পরীক্ষা করছেন। শত শত মশাভর্তি একটা বদ্ধ খাঁচার ভেতর তাঁরা একজন মানুষের হাত ঢুকিয়ে দেন। হাতে মাখা থাকে সেই ঘ্রাণ, যেটা নিয়ে তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। এই ঘ্রাণের বিপরীতে মশা কীভাবে সাড়া দিচ্ছে, লক্ষ করার জন্যও একধরনের সেন্সর ব্যবহৃত হয়। মশাগুলো মানুষটির হাতে কামড়ায় কি না, সেটাই দেখার বিষয়। দুটি মশা কামড়ালেই পরীক্ষাটি ব্যর্থ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু অবাক করা ফলও তাঁরা পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে হচ্ছে কামুদিনী (লিলি অব দ্য ভ্যালি) ফুলের ঘ্রাণকে, যা অনেক পারফিউম তৈরিতেই ব্যবহৃত হয়। মানুষ নিজের গায়ে বা কাপড়ে যেমন ঘ্রাণ পছন্দ করে, এই ঘ্রাণ তার সঙ্গে মানানসই।
পরের ধাপটা সবচেয়ে কঠিন। যার ওপর নির্ভর করছে সাফল্য। ডিএসএম-ফার্মেনিকের মশাবিশেষজ্ঞরা তাঁদের আবিষ্কৃত সেরা সুগন্ধিটি তুলে দেবেন প্রতিষ্ঠানের পারফিউম বিশেষজ্ঞদের হাতে। কীভাবে, কতখানি ব্যবহার করলে ঘ্রাণটা সারা দিন স্থায়ী হবে, তা নিয়ে শুরু হবে কর্মযজ্ঞ।
কাজটা সহজ নয়। সুগন্ধি উপাদান খুবই নাজুক জিনিস। হাতে ঘষা কিংবা কাপড় ধোয়ার কাজে ব্যবহৃত হলে ঘ্রাণ দ্রুতই মিলিয়ে যেতে পারে। (আপনার সদ্য ধোয়া কাপড় থেকে ঘ্রাণ কত দ্রুত হারিয়ে যায়, ভেবে দেখুন!) সারা দিন গায়ের সঙ্গে মিশে থাকবে, এমন ঘ্রাণ তৈরি করতে প্রচুর উদ্ভাবন ও ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের জটিল সংমিশ্রণ প্রয়োজন। এবং সব কথার শেষ কথা, দিন শেষে ঘ্রাণটা ভালো হতে হবে, যেন মানুষ প্রতিদিন ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়।
আমি আশাবাদী, জেনেভার বিজ্ঞানীরা সফল হবেন। একদিন মশাপ্রবণ এলাকার মানুষেরা কোনো বাড়তি চেষ্টা বা খরচ ছাড়াই মশা থেকে সুরক্ষা পাবে, এই আশায় গেটস ফাউন্ডেশন গবেষণাটিকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিশু, আমাদের পরিবারের হাতে নতুন কিছু তুলে দিয়েই আমরা হয়তো তাদের ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী’টির হাত থেকে বাঁচাতে পারব।