বাংলাদেশের ওপেল যেভাবে অস্ট্রেলিয়ার ৫৩ রেস্তোরাঁর অংশীদার
অস্ট্রেলিয়ায় ফরাসি খাবারের পদ তাঁর হাতে নতুন মাত্রা পেয়েছে। ওপেল খান এবার বাংলাদেশি খাবারকে সে দেশে জনপ্রিয় করতে চালু করেছেন নতুন এক রেস্তোরাঁ। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই রন্ধনশিল্পীর গল্প শোনালেন কাউসার খান
দিন কয়েক আগে জরুরি প্রয়োজনে সিডনির পাসপোর্ট অফিসে যেতে হয়েছিল। দায়িত্বরত কর্মী কাগজপত্র জমা নিয়ে জানালেন, বিকেল চারটা নাগাদ আসুন। তখন বাজে মোটে দেড়টা। সময়টা বসে বসে না কাটিয়ে বেরিয়ে পড়ি। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি ক্রাউন স্ট্রিটে। সিডনির এই এলাকায় নামী অনেক রেস্তোরাঁ আছে। তার মধ্যে নীল রঙের একটি সাইনবোর্ডে হঠাৎ চোখ আটকে যায়, সেখানে বড় করে লেখা ‘খানা’। তার নিচে একটু ছোট হরফে লেখা ‘বাই ওপেল খান’।
খানা ও ওপেল খান—দুটি নামই সিডনিবাসীর কাছে পরিচিত। ওপেল খান এ দেশে তারকা রন্ধনশিল্পী। তার চেয়েও বড় কথা আমার স্বদেশি। তাঁর নতুন প্রয়াস এই ‘খানা’। গত সেপ্টেম্বরে রেস্তোরাঁটি চালুর পর অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় জাতীয় পত্রিকাসহ গণমাধ্যমগুলো প্রতিবেদন করেছে। তখনই জেনেছি, বাংলাদেশি খাবার নতুন আঙ্গিকে ভিনদেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই এটি চালু করেছেন ওপেল।
কৌতূহল নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকি। কিন্তু কপাল খারাপ, রেস্তোরাঁটি স্থানান্তরের কাজ চলছে। কর্মীরা জানান, সিডনির বিখ্যাত ডার্লিং হারবারে বড় পরিসরে রেস্তোরাঁটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খেতে না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়েই সেদিন তাই মেনুটা ঘেঁটে দেখেছি! পরিচিত খাবারের মধ্যে প্রথমেই চোখে পড়ল সমুচা আর আলু পাকোড়ার নাম। আরও আছে টমেটোর চাটনি, পায়া, কোরমা, শাকভাজি, শামিকাবাব, পোলাও, চিকেন বিরিয়ানি, চিংড়ি পিঠা, আলুভর্তা, চা, জিরা বিস্কুট ও পায়েসের নাম। ইংরেজি অক্ষরে লেখা প্ল্যাটারের নাম পিচ্চি নলা, মিষ্টি, বড় নলা। মেনুর বেশির ভাগ খাবার সম্পর্কে অস্ট্রেলীয়দের উপযোগী করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
সেদিনই ফোনে ওপেল খানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। বাংলাদেশি পত্রিকার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করেছি শুনেই অপর প্রান্ত থেকে ওপেল খান বলে উঠলেন, ‘এই প্রথম মনে হচ্ছে জীবনে কিছু একটা হয়তো অর্জন করেছি।’
প্রায়ই যে মানুষের ছবি ভোগ অস্ট্রেলিয়া, সিডনি মর্নিং হেরাল্ড, ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মেইলসহ রান্নাবিষয়ক নামী পত্রিকা ও সাময়িকীতে দেখা যায়, কেন তিনি এসব কথা বললেন? ওপেল বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় অনেকে চিনলেও বাংলাদেশে কয়জন আর চেনেন! অথচ আমি তো বাংলাদেশেরই। তাই যখন বাংলাদেশি পত্রিকার পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে কথা বলবেন বলছেন, তখন এটিই মনে হলো।’
ব্যস্ত মানুষটির সময় পাওয়া কঠিন। সেই সময়ও মিলল ১৫ এপ্রিল।
মাফিয়া খাতুনের কথা ভুলি কী করে
ফরাসি খাবার রেঁধেই প্রথম খ্যাতি পেয়েছেন ওপেল খান। তারপর একসময় তাঁর মনে হলো, নিজের দেশের খাবারটাই তো মানুষকে খাওয়াতে পারলেন না। তাই গত বছর চালু করলেন ‘খানা’। এটি তাঁর ৫৩তম রেস্তোরাঁ আর নিজস্ব মালিকানায় চতুর্থ। ‘খানা’ ছাড়াও সিডনিতে ওপেল খানের ‘মিতিস’, ‘পিৎজা বকনে’, ‘আকুয়ে ই ফারিনা’ নামের তিনটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। এখন বাংলাদেশের খাবার নিয়ে নানা নিরীক্ষা করছেন তিনি।
কিন্তু শেফ হলেন কী করে, জানতে চাই ওপেলের কাছে। ওপেল খানদের আদি বাড়ি ময়মনসিংহে। সত্তরের দশকে ঢাকায় তাঁর জন্ম। বাবা আনোয়ার হক খান ও মা লুৎফারানি চৌধুরীর ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ওপেল খান। ১৯৮৯ সালে মা-বাবার সঙ্গে সিডনি চলে আসেন তিনি। ঢাকা থেকে সবে তখন ও-লেভেল করেছেন, বয়স মোটে ১৬ বছর। সিডনিতে এসে ভর্তি হন ফ্যাশন ডিজাইনে।
দুই বছরের কোর্স। ফ্যাশন ডিজাইনে পড়াশোনা করলেও তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্র ছিল ব্যবসা। ১৯৯১ সালে এক পাচক বন্ধুর হাত ধরে শুরু করেন রেস্তোরাঁ ব্যবসা। প্রথম রেস্তোরাঁ চালুর পাঁচ বছরের মাথায় ছয়টি রেস্তোরাঁর মালিক হয়ে যান। সিডনিতে সে সময় উপমহাদেশীয় খাবারের রেস্তোরাঁ ছিল হাতেগোনা। আর বাংলাদেশি খাবারের রেস্তোরাঁ তো খুঁজেই পাওয়া যেত না। তত দিনে তাঁর মা-বাবা আবার বাংলাদেশে ফিরে গেছেন। তাই বৃষ্টির দিনে ইলিশ-খিচুড়ি খেতে ইচ্ছা করলেও খেতে পেতেন না। কখনো কখনো মনে হতো, চিতই পিঠা আর মুরগির মাংস দিয়ে যদি জমিয়ে পেটপূজা করতে পারতেন। পছন্দের এসব খাবারের অভাববোধ থেকে নিজেই এক সময় রান্না করতে শুরু করেন। আর এসব রান্নার সময় মাফিয়া খাতুনকে খুব মনে পড়ত। কে এই মাফিয়া খাতুন?
ওপেল বলেন, ছোটবেলায় যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। বাড়িতে রান্নার জন্য কয়েকজন লোক ছিলেন। তাঁদেরই একজন মাফিয়া খাতুন। তিনিই আমাকে পছন্দের সব খাবার রেঁধে খাওয়াতেন। এই রাঁধুনির হাতের রান্নায় জাদু ছিল। ছোটবেলায় দেখতাম, মায়ের সঙ্গে সারাক্ষণ তিনি রান্নাঘরে কাজ করছেন। আমিও ছিলাম মায়ের নেওটা। সারাক্ষণ খাই খাই করতাম। ছোটবেলায় আমার খাদ্যপ্রীতি দেখে প্রায়ই নাকি মা বলতেন, খাবারদাবার নিয়েই ছেলেটা কিছু করবে। হলোও তা-ই।
তরুণ বয়সেই রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর ওপেলের মনে হলো, জীবন-জগৎটা আরও দেখার আছে। একে একে সিডনির সব ব্যবসা বিক্রি করে দিলেন। সব ছেড়ে চলে গেলেন লন্ডনে। সেখানে ছিলেন বছর দুই। তখনই প্রথম পেশাদার রান্নার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। ফরাসি ও ইউরোপীয় রান্না প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখার তাগাদা বোধ করেন তিনি। এরপর চলে গেলেন ফ্রান্সের মন্টিসেলোতে। সেখানে ফরাসি এক শেফের কাছে রান্নায় হাতেখড়ি। তাঁর সঙ্গে কাজ করলেন এক বছর। তারপর মনে হলো, খাবারে ভিন্নতা আনতে আরও পদের স্বাদ বোঝা দরকার। বেরিয়ে পড়লেন ইউরোপ সফরে। ওপেল বলেন, ‘রন্ধনশিল্পের সব দিক নিয়ে আমি উৎসাহী ছিলাম, আমি চাইতাম খাবারের প্রতিটি উপাদান ও স্বাদ যেন সর্বোচ্চ মানের হয়।’
আবার যখন সিডনিতে ফিরে এলেন, ততদিনে ওপেল একজন পুরোদস্তুর রন্ধনশিল্পী। বিভিন্ন দেশের খাবার নিয়ে একে একে গড়ে তুললেন নামকরা সব রেস্তোরাঁ। শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই নয়, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ২০টির বেশি রেস্তোরাঁ পরিচালনা করেছেন ওপেল খান। ২০২২ ও ২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার সেরা ফরাসি রেস্তোরাঁর খেতাব পেয়েছে ওপেলের রেস্তোরাঁ।
সঙ্গী হলো দুই মেয়ে
স্ত্রী জুলি খান আর দুই মেয়ে জেসমিন খান ও লুসি খানকে নিয়ে সিডনিতে থাকেন ওপেল। পরিবারের সব সদস্যই তাঁর ব্যবসার অংশীজন। বাবার মতো মেয়ে লুসি খানও পাকা রাঁধুনি। খানার প্রধান শেফও তিনি। আর ব্যবসা দেখভালের পাশাপাশি দারুণ গান করেন জেসমিন খান। গানবাংলা চ্যানেলেও গান গেয়েছেন তিনি। ২০১৮ সালে সেই গানের রেকর্ডিং অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মেয়ের সঙ্গে দেশে এসেছিলেন ওপেল খান।
তরুণদের রান্নাও শেখান ওপেল খান। অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর হাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক শেফ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও খুব জনপ্রিয় ওপেল খান। ইনস্টাগ্রামে প্রায় ২২ লাখ মানুষ তাঁর কাজ অনুসরণ করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় বর্তমানে খাদ্যবিজ্ঞান বিষয়ে অনলাইনভিত্তিক কোর্সও করান তিনি।
যেখানে যা-ই করেন, ওপেলের হৃদয়ে থাকে বাংলাদেশ। করোনাকালের পর আর দেশে আসেননি তিনি। আসছে মে বা জুন মাসে বাংলাদেশে আসার পরিকল্পনা আছে তাঁর। ঢাকা আর ময়মনসিংহে ঘুরে বেড়াবেন, পরখ করবেন শৈশবের পছন্দের সব খাবার।