বাড়ি বানানোর কথা ভাবছেন? এখন কোন ট্রেন্ড চলছে, জানেন তো?
মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, অন্যান্য উন্নয়নের ধারা একটি নতুন ও স্মার্ট ঢাকার সংকেত দিচ্ছে। কিন্তু আবাসনের বিষয়টি এখনো একপ্রকার অনিয়ন্ত্রিত পড়ে আছে। কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। ঢাকার বসত-আবাসন নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার কথা বললেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সাজিদ বিন দোজা
মোগল আমলে ঢাকা ছিল বাগানশহর। শাহবাগ, রমনা, গুলিস্তান, ওয়ারীসহ বিভিন্ন এলাকাজুড়ে ছিল বাগান। বুড়িগঙ্গার পাশে বেড়ে ওঠা নগরীটিতে তখন সবকিছুতেই ছিল সাম্য। নৌবলয়ের শাখা–প্রশাখার মাধ্যমে শহরটি তখন সংযুক্ত ছিল। জলবলয় ও বুড়িগঙ্গার শুদ্ধ ধারাপ্রবাহের কারণে তখন ‘টেকসই নগরী’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ঢাকা। পরিবেশ ছিল নির্মল। বসত–বিন্যাসও ছিল অনন্য।
মোগল শহরটির প্রাণ ছিল চকবাজার। চকবাজারকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল মোগল মহল্লা-বসতি। ছিল মসজিদ ও বাজার–মহল্লার পাবলিক স্পেস। সেখানে মহল্লাবাসী ভাবের আদান-প্রদান করতেন সাবলীল। শক্তিশালী সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।
আবাসনের নগরী হিসেবেও অতীত ঢাকা ছিল সমৃদ্ধ। দিনভর উঠান থাকত প্রাণচঞ্চল। একান্নবর্তী পরিবারে ‘টানাপোড়েন’ মানুষগুলোকে মায়া-ভালোবাসার বন্ধনে আগলে রাখত। ছাদ–সামাজিকতা ছিল মহল্লাবাসীর অনন্য এক সংস্কৃতি।
উপনিবেশের সময়ও ঢাকার বসতব্যবস্থা ছিল অতুলনীয়। ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে বিভিন্ন বিদেশি স্থপতির (রিচার্ড বব বুই, ড্যানিয়েল ডানহাম, ডক্সিয়াডিস, পল রুডলফ প্রমুখ) দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করা ও স্বাধীনতাযুদ্ধের পরপর স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলামের অনুরোধে জগৎখ্যাত স্থপতি লুই কানের ঢাকায় আসার কারণে বসতভিটায় আসে ভিন্নতা। নব্বইয়ের দশকের কিছু পর থেকে বসতের সুদিন ও পরিস্থিতি—দুটিরই ক্রমে অবনতি ঘটতে থাকে। আর এখনকার অবস্থা তো ভঙ্গুরপ্রায়। অতীতের ভালো সবকিছুই আজ বিলীন। অথচ অতীতকে ভুলে সামনে বেশি দূর এগোনো দুষ্কর, দুই সময়ের মধ্যে সুতার টান থাকা জরুরি।
যানজট, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ আর নগরজীবনের নানা জটিলতায় শহরবাসী আজ নাকাল। তবে সমস্যা যেমন আছে, সমাধানের পথও
কিন্তু আছে।
আবাসিক বাড়ির স্থাপত্য ভাবনা
শুধু ইট, কাঠ, বালু আর সিমেন্ট দিয়েই বসত হয় না, বিশদ শৃঙ্খলের বিষয়টিও এর সঙ্গে সঙ্গে জড়িত। একটি এলাকা, মানুষের সমাগম, পরিবেশ—সর্বোপরি রাষ্ট্রের মঙ্গল–অমঙ্গলও বসতের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
একটা সময় ছিল, ঢাকাতে মাথা গোঁজার একটু ঠাঁইয়ের জন্য বিভিন্ন রিয়েল স্টেট কোম্পানিতে সব সঞ্চয়-পুঁজি দিয়ে আসতেন শহরবাসী। আজও নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে আবাসনশিল্প। আজও মেঘের আড়ালে সমন্বিত কোনো স্কিম বা পলিসি। আজও গ্রাহক–অনুকূল নয় আবাসনশিল্প। তবে বসত-খদ্দেররা আজ অনেক সচেতন। গত দুই দশকে মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন এসেছে, আবাসনের অনেক বিষয়ে তাঁরা ওয়াকিবহাল। আবাসনশিল্পও কিছুটা হলেও এ রূপান্তরকে স্বীকার করছে।
কী রূপান্তর
গত দুই দশকে ঢাকার আবাসিক উন্নয়ন একপ্রকার অনিয়ন্ত্রিত ছিল। সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও কর্তৃপক্ষ এ দায় এড়াতে পারবে না। মানুষ এখন সচেতন, সচেতন তাঁর পরিবার। গ্রাহকের প্রয়োজন ও উপযোগিতাকে প্রাধান্য দিতে বাধ্য আজকের আবাসনশিল্প। ভোক্তা অথবা খদ্দেররা সেই জায়গাটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
অতিমারির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আঘাতও স্থাপত্যে এসে পড়েছে। অন্দর নকশাতেও এসেছে পরিবর্তন। নিবাসটি বুঝে নেওয়ার ব্যাপারে গ্রাহক এখন অনেক সচেতন। সব পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। কমপ্লায়েন্সের দিক থেকে আবাসনশিল্প এখন অনেক সর্বাঙ্গীণ ও বিস্তৃত। ফলে ইন্ডাস্ট্রিতে এখন তুমুল প্রতিযোগিতা।
আপনার বসতের অবস্থান
নিজের এক টুকরা নীড় সবাই চান। যে এলাকাতে আবাসন পছন্দ করছেন, সেই এলাকার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা দরকার। আপনি নিজেই সেটা করতে পারেন।
এই যেমন—
প্রধান সড়ক থেকে আপনার জমির উচ্চতা।
জমির আশপাশের পরিবেশ। কারখানা, গার্মেন্টস, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি অথবা বদ্ধ পানিপ্রবাহ, হাই ভোল্টেজ গ্রিড—এসব আপনার আবাসিক এরিয়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে আছে কি না।
দিক নির্ণয়। আপনি যেখানে বসত করতে চাইছেন, তার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমের অবস্থান দেখে নেওয়া জরুরি। আপনার ফ্ল্যাট কি পুবের আলো পায়?
হঠাৎ দুর্ঘটনায় অগ্নিনির্বাপণ গাড়িটি আপনার ভবনের সামনে এসে সব ধরনের উদ্ধার অভিযান অনায়াসে করতে পারবে তো?
বসতকাঠামোর বৈজ্ঞানিক অনুমান
আবাসটি অবশ্যই ফ্রেম স্ট্রাকচারড হবে।
ভূমিকম্প সহনশীল হবে।
জলছাদ ও ডিপিসি করা দরকার।
পেস্ট কন্ট্রোল দরকার।
আধুনিক নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার
আপনার আবাসনটি আপনার মেহনতে গড়া সুখের ঠিকানা। তাই বিল্ডার্সরা সমসাময়িক নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করছে কি না, অবশ্যই জানা দরকার। একটি আবাসনের অন্দর–বাহিরকে মানসম্মত, আধুনিক ও সৃজনশীল সামগ্রীর সমন্বয়ে নানাভাবে সমৃদ্ধ করা যায়। এসবে কোন ধারা চলছে, এ সম্পর্কে অবগত হওয়া তাই খুব জরুরি।
মালিকানা হস্তান্তরও জরুরি একটি কর্মযজ্ঞ। বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে আপনাকে অ্যাকশন প্ল্যানে যেতে হবে। আরও গভীরে কিছু জটিলতা থাকবে, ভূমি অফিস, নামজারি ইত্যাদিও বুঝে নিতে হবে।
কোন তলায় আবাস
সহজ করে বললে, আপনার নীড়টি সহনীয় তলায় হতে হবে, লিফট অকেজো হয়ে গেলেও যাতে সহজে ওঠানামা করা যায়। আবার অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থাও যেন হাতের নাগালে থাকে, এমন তলায় আপনার অ্যাপার্টমেন্ট রাখার চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গে যেন পর্যাপ্ত আলো–বাতাস থাকে।
কোন দিকে আবাসনের ট্রেন্ড
ঢাকা শহরে ৭০ শতাংশ মানুষেরই এখনো নিজস্ব আবাসন বা ঠিকানা তৈরি হয়নি। কাজের খোঁজে নগরীতে প্রতিদিন আসছেন মানুষ, অনিচ্ছায় বেছে নিতে হচ্ছে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাই। তবু ঢাকা শহরের জীবনপ্রবাহের চাকা থেমে থাকবে না, দিন দিন গতিশীলতা বরং আরও বাড়বে। আবার সবাই ঢাকা মহানগরীতে থাকতে পারবেন না, এটাও বাস্তবতা।
আধুনিক ঢাকার জীবনযাত্রার মান বদলেছে। চিন্তাধারার পরিবর্তন এসেছে, চাহিদার অনেক প্রকার তৈরি হয়েছে। কম সময়ে এখন সমাধান খোঁজেন মানুষ। তাঁরা ওয়ান–স্টপ সল্যুশনে বিশ্বাসী। সাসটেইনেবল ম্যাটার বা টেকসই অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো আজকের আবাসনের চলতি ধারা। ভবনে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে নির্মাণসামগ্রী স্থাপন, পরিবর্ধন বা পরিযোজন এখন দৃশ্যমান।
আবার সহজে মেইনটেইন করা যায়, এমন ছোট পরিসরের ফ্ল্যাট এই প্রজন্মের পছন্দ। উন্মুক্ত অন্দর হলে আবাসন হবে আলো–বাতাসে পূর্ণ। স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টও আজকের দিনের কনসেপ্ট।
বহুমুখী ব্যবহারের কারণে মহানগরী ছাড়াও দেশের জেলা শহরে হোমস্টে ব্যবস্থা জনপ্রিয় হচ্ছে।
রঙের ব্যবহারেও বসতির গ্রাহকেরা এখন বেশ ওয়াকিবহাল। আজকাল উজ্জ্বল রঙের চাহিদা বেশি। নিজ বসতের কমন স্পেসটিও ঠিকঠাক মানের আছে কি না, এ ব্যাপারেও গ্রাহকেরা আজকাল বিল্ডার্সের সঙ্গে বোঝাপড়া করেন।
আবাসিক ভবনের চলতি ধারায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বারান্দা ও টেরাস। নিজ বসতে কিছু জায়গা কম রেখে হলেও প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে চান মানুষ। বড় বারান্দা বা টেরাস এখন আবাসনের অন্যতম মূল চাহিদা। সেই সঙ্গে বাড়ির সামনে খানিকটা খোলামেলা পরিবেশ, গাছপাতা দেখতে চান তাঁরা।
বসত গ্রাহক এখন ‘ট্রেন্ডি শহুরে বাগান’ করতে তৎপর। বাগান করার ব্যবস্থা আছে কি না, এ বিষয়ে ভবন নির্মাতার থেকে নিশ্চয়তা চান তিনি। সর্বোপরি প্রতিবেশীর ব্যাপারে জানতে চান তাঁরা, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে কীভাবে নিজেকে অভিযোজিত করবেন, সেটাও তাঁর সম্পৃক্ততার অংশ।
মোটাদাগে বলতে গেলে, আবাসন বা বসতের বিন্যাস, আঙ্গিক ও পরিবেশনার গল্পটি আজ আর আগের মতো নেই। দুই দশক আগেও এসব বিষয়ে শুধু ভবন নির্মাতার একতরফা প্রাধান্যই দেখা যেত। বাস্তবতা আজ অনেক পরিবর্তিত। এক পক্ষের ইচ্ছায় আবাসন বিক্রি হয় না, উভয় পক্ষের বোঝাপড়া ও আলোচনার সাপেক্ষে উইন–উইন অবস্থান সৃষ্টি হওয়া জরুরি। আবাসন ট্রেন্ডসের এটাও একপ্রকার সংস্কৃতি।