ছোট ভাই দেখে বুঝলেন, এটাই তাঁর ৫০ বছর আগে বাড়ি ছেড়ে আসা বড় ভাই
ক্ষুধার কষ্ট সইতে না পেরে শৈশবে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন শমসের হোসেন। কিছুদিন এখানে-সেখানে কাজ করে চলে যান ঢাকা। এরপর কেটে যায় ৫০ বছর। তারপর একদিন গল্পের মতো একটা ঘটনা আবার তাঁকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে এনেছে। সৈয়দপুরে শমসেরের কাছে সেই গল্পই শুনে এসেছেন এম আর আলম
সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের পাশেই বাড়াইশালপাড়া আশ্রয়কেন্দ্র। গৃহহীন মানুষের বসত। আশ্রয়কেন্দ্রের এঘর-ওঘর করে আমরা যাই অশীতিপর সবেজান বেওয়ার কাছে। রান্নার জন্য তরকারি কুটছিলেন তিনি। আমাদের দেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান। সাংবাদিক পরিচয় জেনে আগমনের উদ্দেশ্যও বুঝে ফেলেন। তাঁর বড় ছেলে শমসের হোসেনের বাড়ি ফেরার খবরে পরিচিত অনেকের মতো সাংবাদিকেরাও যে এসেছেন। নিজেই পথ দেখিয়ে আমাদের নিয়ে যান আশ্রয়কেন্দ্রের সামনের এক দোকানে। দোকানটি তাঁর ছোট ছেলে আবদুস সালামের। সেই দোকানের বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছিলেন শমসের হোসেন।
আমাদের আরও কাছে এগিয়ে আসেন ষাটোর্ধ্ব শমসের, চোখে রোদচশমা। ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগে সৈয়দপুরে এসেছেন। ভাই-বোনদের সঙ্গে এত দিন পর দেখা হবে, ভাবতেই পারেননি। ভাবতে পারেননি মাকেও দেখতে পাবেন। বললেন, ‘চোখে ছানি পড়ায় সব ঝাপসা দেখতাম। বাড়িতে ফেরার পর ভাই-বোনেরাই অপারেশন করাইছে। এখন পরিষ্কার দেখি।’
তারপর অল্প অল্প করে তাঁর কাছ থেকে শুনি বাড়ি ফেরার গল্প।
ভাই, আপনের বাড়ি কই?
ঢাকার মোহাম্মদপুরে রিকশা চালাতেন শমসেরের ছোট ভাই মোতালেব হোসেন। বয়সে দুই বছরের ছোট-বড় তাঁরা। মোতালেব একদিন যাত্রী নিয়ে বংশাল এলাকায় গেছেন। দেখেন তাঁরই মতো দেখতে একটা লোক রিকশায় বসে আছে। চেহারা দেখে মোতালেবের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, বড় ভাই শমসের না তো!
কিন্তু অপরিচিত একজন মানুষকে কীভাবে কথাটা জিজ্ঞেস করবেন, ভেবে পান না মোতালেব। তাই সেদিন ফিরে আসেন। মোহাম্মদপুরের ছোট্ট বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি। রাতে গল্পে গল্পে স্ত্রী-সন্তানকে বলেনও ভাইয়ের মতো একজনকে দেখেছেন।
প্রায়ই এরপর রিকশা নিয়ে নবাবপুর এলাকায় যেতে থাকেন মোতালেব হোসেন। নবাবপুর রোডে কাজী মকবুল হোসেন নামের এক লোকের পানের দোকান আছে। দোকানটার সামনে রিকশা রেখে প্রায়ই সেখানে এসে বসতেন শমসের। মোতালেবও দোকানে গিয়ে বসতে থাকেন। দুজনে নানা বিষয়ে কথা হতো। পানের দোকানির কাছেও শমসের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। কথায় কথায় মোতালেব একদিন জানতে চাইলেন, ‘ভাই, আপনের বাড়ি কই?’
জেলা-উপজেলা বলতে না পারলেও শমসের শুধু বলেছিলেন, ‘বাড়াইশালপাড়া, ক্যান্টনমেন্টের পাশে।’
মোতালেবের অবশ্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। যা বোঝার বুঝে ফেললেন। এই রিকশাচালকই তাঁর বড় ভাই শমসের। তারপরও বড় ভাইকে নিজের পরিচয় দেননি। যদি রাগ করে আর দেখা না করেন।
তবে একদিন সুযোগ বুঝে পরিচয়টা দিয়েই ফেলেন মোতালেব। তারপর মুখোমুখি বাকরুদ্ধ দুই ভাই। সেদিন শমসের অবশ্য কিছুটা বিব্রতও হন। মা বেঁচে আছে, ভাইদের তিনি আর খোঁজ নেননি। তিনি চলে যেতে চান। মোতালেব তাঁকে আর ছাড়েন না। ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন।
চায়ের দোকান থেকে আমাদের আলাপে যোগ দেন আবদুস সালাম, ‘বড় ভাইকে বাড়িতে আনার ব্যাপারে তখনই আলাপ হইছিল। কিন্তু এর মধ্যে করোনা শুরু হয়। করোনায় মেজো ভাইটা মারা যায়।’
মোতালেব মারা যাওয়ার খবর অনেক দিন পর জানতে পারেন শমসের হোসেন। জানেন মোতালেবের ছেলের কাছে। করোনা–পরবর্তী সময়ে বাবার পথ ধরে নবাবপুর গিয়ে জ্যাঠাকে খুঁজে বের করেন। তত দিনে শমসেরের চোখে ছানি পড়ে গেছে। তেমন দেখতে পান না। তারপর ঢাকায় যান আবদুস সালাম। ঈদুল ফিতরের আগে বড় ভাইকে বাড়ি নিয়ে আসেন।
খেতে না পারার কষ্ট
বাড়াইশালপাড়া গ্রামের রজব মাহমুদ ছিলেন ভিটেমাটি ছাড়া মানুষ। অন্যের জমিতে ঘর তুলে থাকতেন। সংসার চালাতেন দিনমজুরি করে। ১৯৭৩ সালে উত্তরাঞ্চলে প্রচণ্ড অভাব চলছিল। মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী ওই সময়ে মানুষের হাতে তেমন কাজকর্মও ছিল না। সন্তানদের মুখে ঠিকমতো খাবার দিতে পারতেন না। ১৩ বছরের শমসেরের ক্ষুধার কষ্ট সহ্য হতো না। এ নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে রাগারাগি করতেন। সিদ্ধান্ত নিলেন দূরে কোথাও গিয়ে কাজ করবেন, নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করবেন। তারপর একদিন অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।
সৈয়দপুর স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চড়ে বসলেন। ট্রেনটি গিয়ে দাঁড়ায় পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশনে। একটি চায়ের দোকানে কাজ জুটে যায়। পেটে-ভাতে ভালোই কাটছিল শমসেরের দিন। তিনি বলেন, ‘রাতে চা দোকানের মালিকের বাসাতেই থাকতাম। এখানে চার বছর থাকি। এ সময় ওই টি স্টলের আরেকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে সে আমাকে ঢাকায় নিয়ে যায়।’
ঢাকায় এসে পুরান ঢাকার রথখোলায় রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ শুরু করেন শমসের হোসেন। এভাবে কাজ করে করে কিছু টাকা জমিয়ে একটি রিকশা কেনেন। রিকশা চালিয়ে থাকতেন নবাবপুর রোডের একটি মেসে। ১৯৯৫ সালের দিকে বিয়ে করেছিলেন। দুই বছরের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
নিঃসন্তান শমসের অনেকবার বাড়ি ফেরার কথা ভেবেছেন। কিন্তু অক্ষরজ্ঞানহীন শমসের তত দিনে গ্রামের নাম ছাড়া সবই ভুলে গেছেন। এর মধ্যে চোখে ছানি পড়তে থাকে। একরকম ধরেই নেন আর কোনো দিন পরিবারের কারও সঙ্গে দেখা হবে না। তখনই ছোট ভাই মোতালেবের সঙ্গে পরিচয়।