হাঁড়িতে চাল থাক বা না থাক, নৌকাবাইচ ছাড়া তাঁদের চলেই না
বছরের প্রায় পাঁচ মাস জলমগ্ন থাকে চিনাধুকুড়িয়া। এই গ্রামের পশ্চিমপাড়ার পুরুষেরা তখন নৌকাবাইচে নেমে যান। প্রতিযোগিতাটা বংশপরম্পরায় তাঁদের রক্তে মিশে আছে। হাঁড়িতে চাল থাক আর না থাক, জেলায় জেলায় নৌকাবাইচে অংশ নিতে ছুটে যান তাঁরা। শাহজাদপুরের গ্রামটা ঘুরে এসেছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
হারুন অর রশিদ মালয়েশিয়ায় যাবেন। বিমানের টিকিট আগেভাগেই কাটা ছিল। যেদিন ফ্লাইট, তার আগের দিন গ্রাম থেকে খবর গেল নৌকাবাইচের সময় ঠিক হয়েছে। ফ্লাইট বাতিল করে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে এলেন হারুন। নৌকাবাইচে অংশ নিয়ে তবে যাবেন মালয়েশিয়ায়।
নৌকাবাইচের প্রতি হারুনের এই অকৃত্রিম টানের গল্প এক বন্ধুর মুখে শুনি। একই গ্রামের মানুষ তাঁরা। মনে মনে বলি, শুধু নৌকাবাইচের জন্য এমনটা করতে পারেন একজন মানুষ?
বন্ধুটি হয়তো আমার মনের কথাটা বুঝতে পারেন। তিনি জানান, প্রায় পাঁচ মাস জলমগ্ন থাকে চিনাধুকুড়িয়ার পশ্চিমপাড়া। চারদিকে থই থই করে পানি। এ সময় কোনো কাজ থাকে না। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতেও লাগে নৌকা বা বাঁশের সাঁকো। তখন নৌকাবাইচ খেলায় মেতে ওঠেন তাঁরা।
এসব গল্প শুনে ইচ্ছা হয় চিনাধুকুড়িয়া ঘুরে আসি। গত ২৪ অক্টোবর রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জের পথ ধরি। নানা পথ মাড়িয়ে গ্রামে যাওয়ার খেয়ানৌকায় উঠতেই শোনা গেল মাঝি শুকুর আলীর খেদ, ‘এবার পানি আইল নাবি হইরা। নাইমা যাচ্ছে তারাতারি।’ মানে দেরিতে পানি এসে তাড়াতাড়ি নেমে যাচ্ছে। নৌকাবাইচের সময়টা কম পাওয়া গেল।
চিনাধুকুড়িয়ার জীবন বড় কঠিন। বেশির ভাগ মানুষই নিম্নবিত্ত। এমনও আছে ১ শতাংশ জমির ওপরে চার ভাই মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করেছেন। তবে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে তাঁরা গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সংস্কৃতি। কথায় কথায় তাঁরা জারিগান বাঁধেন। সেই গান গেয়েই নৌকা নিয়ে যাত্রা করেন।
সাংবাদিক আইছে
ঘরসংসার নিয়ে কারও মুখে কোনো কথা নেই। শুধু বাঘাবাড়িতে প্রতিপক্ষের কাছে কীভাবে তাঁদের নৌকা হেরে গেল, এটা কেউ মানতে পারছেন না। মোতালেবের শোবার ঘরে একদল মেয়ে টিভির সামনে বসে রয়েছেন। একটি ইউটিউব চ্যানেলে সেই খেলা আপ করা আছে। বারবার সেটিই ঘুরিয়ে দেখছেন তাঁরা, কোন জায়গায় তাঁদের নৌকা পিছিয়ে পড়ল। তাঁরা বলছেন এটার মধ্যে ষড়যন্ত্র আছে।
সাংবাদিক যাওয়ার খবর পেয়ে ৮৫ বছর বয়সী শামসুল প্রামাণিক তাঁর মুদিদোকান ফেলে গাছতলায় এসে দাঁড়ালেন। কবে থেকে গাঁয়ের লোকেরা নৌকাবাইচ খেলে তিনিও জানেন না। এলেন প্রধান মাঝি (হাইলা) সাইদুর রহমান। মাঝি হিসেবে বাইরেও ভাড়ায় খেলতে যান তিনি। তিনি বলেন, ‘বুদ্ধি হয়েই খেলছি। হাজার বাইচ খেলেছি।’
মিজানুর রহমান ওরফে মধু সরদার এই গ্রামের মানুষের প্রাণ। এক ডাকে গ্রামের সব নারী-পুরুষকে এক জায়গায় জড়ো করে ফেললেন তিনি। নৌকায় উঠে তাঁরা যে জারিগান করেন, নেচে নেচে একের পর এক তা–ই শোনাতে লাগলেন, ‘তালগাছে সুপারি ধরে কাঁঠালগাছে মুছি, ধরলাম না ছুঁইলাম নারে আমি হইলাম দুষি।/কাক কালো কোকিলা কালো আরও কালো মাথার কেশ। আল মদিনা নৌকাখানি পাগল করল দেশ।’
একের পর এক গান চলতে থাকল। সামনে নৌকার জার্সি পরে নেতৃত্ব দিলেন আয়নাল হক, গিয়াস উদ্দিন, মফিজ উদ্দিন, খলিলুর রহমান, হারুন অর রশিদ, রবিউল হোসেন, বরাত, রাজিব মনিরুজ্জামানসহ অনেকে। বউ–ঝি কেউ আর ঘরে থাকতে পারলেন না। চারদিকে ঘিরে এই গান শুনতে লাগলেন। ৭৫ বছর বয়সী সিরাজুল ইসলাম নাতি জুবায়েরকে কাঁধে নিয়ে গান শুনছিলেন।
আষাঢ় মাসে নতুন পানি পড়লেই গ্রামের মানুষের হাত-পা নেচে ওঠে। আনন্দের বান ডাকে। গ্রামের ইউসুফ সরদারের গানেই তা পাওয়া যায়, ‘পশ্চিমেতে ডগোমগো উত্তরেতে বান, চ্যালা মাছে ডিম পাড়ে পাহাড়ের সমান।’ এই গান তাদের উতালা করে। স্বশিক্ষিত এই গীতিকার চার-পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। আষাঢ়ের প্রথম পানিকে স্বাগত জানাতে এই গান রচনা করেছিলেন তিনি।
গ্রামের বাসিন্দারা কেউ জানেন না কবে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এলাকার এই প্রতিকূল পরিবেশকে আনন্দের অনুষঙ্গ বানিয়ে ফেলেছেন। এখন বংশপরম্পরায় এই খেলা তাঁদের রক্তে মিশে গেছে।
নৌকা ভাঙা, নৌকা গড়া
গানের শেষে নৌকাবাইচের নানা গল্প শুনি। একজন জানান, তাঁরা এবার ১০ লাখ টাকা দিয়ে নৌকা বানিয়েছেন। দুই বছর আগে তাঁরা সাত লাখ টাকা দিয়ে একটি নৌকা তৈরি করেন। সেই নৌকার সামনের দিকে চাপা ছিল। ঘুরতে গেলে সময় লাগে। তাই আরও তিন লাখ টাকা দিয়ে মেরামত করলেন। তবুও ঠিক হলো না। ভাবলেন, এই ত্রুটিপূর্ণ নৌকা অন্যের কাছে বিক্রি করলে প্রতারণা করা হবে। তাই নৌকাখানা ভেঙে ফেললেন তিনি। ১০ লাখ টাকা ব্যয় করে নতুন নৌকা বানালেন। কেউ আনন্দ থেকে যেন বঞ্চিত না হন, সে জন্য গ্রামের ভূমিহীনও এই নৌকার জন্য চাঁদা দেন। হাঁড়িতে চাল থাক আর না থাক নৌকাবাইচ তাঁরা খেলবেনই।
এ বছরের ছয় নৌকাবাইচ
চিনাধুকুড়িয়া পশ্চিমপাড়ার মানুষেরা এবার অক্টোবর পর্যন্ত নৌকাবাইচ খেলেছেন। ছয়টি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চারটি মোটরসাইকেল ও দুটি ফ্রিজ পেয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উৎসব হয়েছে গ্রামের দক্ষিণ পাশে সড়াতৈল এলাকায়। সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে। প্রতি সপ্তাহে দুই দিন করে এখানে নৌকাবাইচ হয়েছে। তিন সপ্তাহ চলেছে। প্রতিদিনই তাঁদের নৌকা আল মদিনা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ১২৫ সিসির মোটরসাইকেল।
টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে যমুনা নদীতে এক দিনের খেলা হয়েছে গত ২০ সেপ্টেম্বর। পুরস্কার পেয়েছেন মোটরসাইকেল। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে খেলা হয়েছে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর জগন্নাথপুরে। মেলাকেন্দ্রিক এই নৌকাবাইচের আসরে বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছিল। মধু সরদার বললেন, এক দিনের মেলায় আমাদের আট দিন ধরে রাখা হয়। প্রতিদিন খেলা হয়। প্রতিদিনই চ্যাম্পিয়ন হই, কিন্তু পুরস্কার ঘোষণা করে না। পরে বুঝতে পারি খেলা দেখিয়ে মেলা চালু রাখছে কর্তৃপক্ষ।
সেই নৌকায় সাতজন মাঝিমাল্লাসহ ১১০ জন ছিলেন। প্রতিদিন তাঁদের সাড়ে তিন হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। মেলা কর্তৃপক্ষ যে সহযোগিতা করার কথা বলে দাওয়াত করেছিলেন, তাঁরা সেটা করেননি। পরে ৯ অক্টোবর পুরস্কার ঘোষণা করা হলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে মোটরসাইকেল জেতেন।
সর্বশেষ ২৩ অক্টোবর বাঘাবাড়ীর বড়াল নদীতে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে তাঁদের নৌকা দ্বিতীয় হয়। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ১১০ সিসি মোটরসাইকেল। একই গ্রামের হবিবুর রহমানের পদ্মা এক্সপ্রেস নৌকাটি অল্পের জন্য প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এ নিয়ে পশ্চিমপাড়ার মানুষের ঘুম নেই।
পথে বের হতেই দেখা গেল, আল মদিনা নৌকার সভাপতি মোক্তার হোসেন বাঘাবাড়ি খেলার পুরস্কার মোটরসাইকেল নিয়ে আসছেন। সবাই তাকে ঘিরে ধরলেন। প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে সভাপতি বললেন, ‘এই পুরস্কারের টাকায় তাঁদের খরচ ওঠে না। পাওয়ার মধ্যে আনন্দটুকুই লাভ।’
বিজয়মালার অপেক্ষায়
পাড়ার পুরুষেরা যখন নৌকাবাইচ খেলে বেড়ান, সে সময় সংসারের দায়িত্ব নেন বউ-ঝিরা। তবে জয়ের আনন্দটা সবার। বিজয়ীর বেশে পুরুষেরা যখন গ্রামে ফেরেন, নেচেগেয়ে তাঁদের বরণ করে নেন নারীরা।
খাদিজা বেগমের স্বামী মারা গেছেন। ২৮ বছরের ছেলে সোলাইমান সংসার চালান। সেই ছেলে চার মাস এখানে–ওখানে নৌকাবাইচ খেলে বেড়ান। পথের লোকজনকে ধরে বাজারঘাট করে তিনি সংসার চালান। যখন যখন খেলা থাকে, পাড়ার সব নারীই একইভাবে সংসার চালান। খাদিজা হেসে বলেন, ‘তাও আমরা খুশি।’
সাথী মনি স্নাতকে পড়েন। তাঁর ভাই রুহুল আমিন এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। স্কুলের টেস্ট পরীক্ষা বাদ দিয়ে কুমারখালীতে সে নৌকাবাইচ খেলতে গেল। গ্রামের সবাই মিলে স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বলে পরে তার পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সাথী বলে, খেলা শুরু হলে ছেলে–বুড়ো আর কাউকে বাড়িতে রাখা যায় না।
গ্রামবাসীর কথা শুনে শাহজাদপুরে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরস্কার’ কবিতার কথা মনে পড়ল। কবিতায় লিখেছেন এক কবির কথা। যাঁর কবিতা শুনে মুগ্ধ রাজা কবিকে বললেন, ‘ভাবিয়া না পাই কী দিব তোমারে,/করি পরিতোষ কোন্ উপহারে,/যাহা-কিছু আছে রাজভান্ডারে/সব দিতে পারি আনি।’
হাঁড়িতে চাল না থাকলেও সেই কবি চাইলেন রাজার গলার ফুলের মালা। বাড়ি ফিরে দেখলেন, ভর্ৎসনার বদলে খুশি হয়ে স্ত্রীও সেই মালাখানাই গলায় পরে নিলেন। এটি ছিল কবির কল্পনা। কবিতা রচনার ১৩০ বছর পরে সেই কল্পনা যেন শাহজাদপুরেই সত্যি হলো। চিনাধুকুড়িয়া গ্রামের বধূরাও শুধু বিজয়মালার জন্যই অপেক্ষা করেন।