বেডরুম পরিবার নাকি লিভিংরুম পরিবার, কোন ধরনের চর্চা ভালো?

লিভিংরুমকেন্দ্রীক পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের ঘনিষ্ঠ থাকেনমডেল: মাইসারাহ, জিতু, মীম ও মেহরাব ছবি: কবির হোসেন

আহনাফের (ছদ্মনাম) বয়স ১৭ আর অন্তরার (ছদ্মনাম) ১৪। তারা ভাই–বোন। বাসায় মা-বাবাসহ চারজন। যার যার অফিস আর স্কুল–কলেজ থাকলেও রাতের খাবারটা প্রায় প্রতিদিন একসঙ্গে খায় তারা। সময় বের করে একসঙ্গে বসে গল্প করে, সিনেমা দেখে আর ছুটির দিনে বেড়াতে যায়। তারা পরস্পরের সঙ্গ উপভোগ করে। ভালো লাগা, খারাপ লাগা পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নেয়।

অন্যদিকে আদনানের (ছদ্মনাম) বয়স ১৩ আর তার বোন যুথীর (ছদ্মনাম) ১৯। তাদের বাড়িতেও মা-বাবাসহ চারজন। দেখা যায় সারা দিন মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত যুথী। আর আদনান ব্যস্ত ল্যাপটপে গেম নিয়ে। প্লেটে খাবার নিয়ে কখনো নিজের রুমে, আবার কখনো ল্যাপটপের সামনে বসে তারা আলাদা আলাদা খায়। মাঝেমধ্যে রেস্তোরাঁয় শুধু তাদের একসঙ্গে বসে খেতে দেখা যায়। বাড়িতে চারজনের একসঙ্গে বসা হয় খুবই কম। যে যার রুমে দরজা বন্ধ করে নিজেদের মতো করে সময় কাটায় তারা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আজকাল এই দুই ধরনের পারিবার নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। আদনান-অন্তরার পরিবারটিকে বলা হচ্ছে ‘লিভিংরুম পরিবার’, আর আদনান-যুথীর পরিবারের গঠনকে বলা হচ্ছে ‘বেডরুম পরিবার’। দুই ধরনের পরিবারের পক্ষেই যুক্তি রয়েছে। সন্তানের বিকাশের জন্য, পারিবারিক বন্ধনের জন্য, ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার জন্য কোন ধরনের পরিবার তুলনামূলক ভালো? লিভিংরুম পরিবারে সদস্যদের মধ্যে যেমন বন্ধন দৃঢ় থাকে, আবার কারও কারও যুক্তি, বেডরুম পরিবারে নিজেকে আলাদা করে বেশি সময় দেওয়া যায়, মি টাইম বেশি থাকে।

বেডরুম পরিবারের বৈশিষ্ট্য

বেডরুমভিত্তিক পরিবারের সদস্যরা নিজ নিজ ঘরে নিজের মত সময় কাটান
মডেল: মৌসুমী মৌ, ছবি: কবির হোসেন

নিজস্ব সময়: এ ধরনের পরিবারের সদস্যরা নিজ নিজ রুমে নিজের আলাদা জগৎ তৈরি করে। সেখানে নিজস্ব সময় আর প্রাইভেসি বেশি গুরুত্ব পায়।

স্বতন্ত্রভাবে সক্রিয় থাকা: বেশির ভাগ সময় টিভি, কম্পিউটার বা মুঠোফোনে সক্রিয় থাকে।

একসঙ্গে কম থাকা: পরিবারের সদস্যরা পরস্পর একসঙ্গে কম সময় কাটায়। এমনকি বেডরুম পরিবারের সদস্যরা সামাজিকভাবেও কম সক্রিয় থাকে।

লিভিংরুম পরিবারের বৈশিষ্ট্য

পরিবারের সঙ্গে বসে টিভি দেখে ও গল্প করে সময় কাটানো যেতে পারে। মডেল: নাসিম আহমেদ, দিনা আলম, আনিলা ও আয়মান, ছবি: সুমন ইউসুফ

একসঙ্গে বেশি সময় থাকা: দেখা যায়, বেশির ভাগ দিন খাবার টেবিলে বা বসবার ঘরে পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে সময় কাটায়। এমন পরিবার একসঙ্গে আড্ডা দেয়, খাবার খেতে ভালোবাসে। একসঙ্গে টিভি দেখে, ক্যারম, লুডু বা অন্যান্য ঘরোয়া খেলা খেলে।

অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেয়: তারা যে কেবল একসঙ্গে থাকে তা নয়, নিজেদের অনুভূতিগুলো পরস্পরের সঙ্গে ভাগ করে নেয়।

পরিবারের সঙ্গে অকপট: কারও মন খারাপ হলে সেটা পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করে। একজন আরেকজনের কাছ থেকে খুব বেশি লুকানোর অভ্যাস নেই।

কোনটি ভালো

বেডরুম পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দৃশ্যমান পারিবারিক বন্ধন কম থাকে। তবে তারা যেহেতু মি টাইম (একান্ত সময়) বেশি পায়, ফলে তাদের একটা ব্যক্তিগত পরিসর তৈরি হয়। তারা স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেড়ে উঠতে পারে। কখনো কখনো পড়ালেখাসহ নিজের কাজে মনোযোগ বেশি দিতে পারে। কখনো কখনো দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পায়। তবে পারিবারিক মিথস্ক্রিয়া কম থাকার কারণে পরস্পরের সমস্যাগুলো তারা জানতে পারে না। আবেগের বহিঃপ্রকাশ কম হওয়ার কারণে একাকিত্বে ভুগতে পারে। আবার কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে একাকী নিজের ঘরে সময় কাটানোর কারণে মা-বাবার তদারকি কম হয়। ফলে তাদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ, ইন্টারনেট আসক্তি বাড়তে পারে, বিঘ্নিত হতে পারে নিরাপত্তা।

বেডরুম পরিবারের সদস্যরা মি টাইম (একান্ত সময়) বেশি পায়
মডেল: মৌসুমী মৌ, ছবি: কবির হোসেন

লিভিংরুম পরিবারের পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়। একজনের সমস্যা সমাধানে সবাই অংশগ্রহণ করে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রাইভেসি (ব্যক্তিগত গোপনীয়তা) কম থাকে। বিশেষ করে কিশোর বয়সীরা অনেক সময় হাঁপিয়ে ওঠে এবং নিজস্বতা হারায়। কখনো কখনো আত্মনির্ভরশীলতা কম তৈরি হতে পারে। পড়ালেখাসহ নিজের কাজে মনোযোগ কম হতে পারে। এই পরিবারের সদস্যরা সামাজিকতায় দক্ষ হয়ে ওঠে।

এই দুই ধরনের পরিবারের মধ্যে মোটাদাগে বলা যাবে না কোনটি বেশি ভালো আর কোনটি ক্ষতিকর। বরং দুটির মিশেলে একটি ভারসাম্যমূলক পরিবার গড়ে তোলা দরকার। সামাজিক ও পারিবারিক নৈতিকতা চর্চার জন্য, মা-বাবার তদারকিতে সন্তানের নিরাপদ বিকাশের জন্য লিভিংরুম পরিবার ভালো। আবার সন্তানের আত্মবিশ্বাস ও মনোযোগ বাড়াতে এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য কখনো কখনো বেডরুম পরিবার পন্থাও কার্যকর। এর অর্থ হচ্ছে পরিবারে সদস্যরা যেমন একসঙ্গে সময় কাটাবেন, আবার মাঝেমধ্যে প্রত্যেকের নিজস্ব সময় কাটানোকেও উৎসাহিত করতে হবে। লিভিংরুম পরিবারের চর্চা করতে গিয়ে যেন আরেকজনের নিজস্ব সময়টাও ছিনতাই হয়ে না যায়। আবার বেডরুম পরিবার কাঠামোর চর্চা করতে গিয়ে যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বেড়ে না উঠি।

প্রতিটি পরিবারেই লিভিংরুমে সময় কাটানোর চর্চাটা বজায় রাখতে হবে। একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা বা একসঙ্গে খাওয়াকে যেমন উৎসাহিত করতে হবে, তেমনি খানিকটা নিজস্ব সময় কাটানোর সুযোগও প্রত্যেককে দিতে হবে। এই ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলেই পরিবার হয়ে উঠবে হাসিখুশি, সুসংগঠিত আর আত্মনির্ভরশীল।

আরও পড়ুন