পাস করে শেখা যায় না: শীর্ষেন্দু

ওপার বাংলার জনপ্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর বহু গল্প, উপন্যাস এপারেও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। সব বয়সের পাঠকের কাছেই তুমুল জনপ্রিয় তাঁর ‘অদ্ভূতুড়ে’ ও ‘শবর’ সিরিজ। একাধিক লেখা থেকে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। যেমন গয়নার বাক্স, দোসর, আশ্চর্য্য প্রদীপ, ইগলের চোখ ইত্যাদি। ভারতের কলকাতার ব্রেইনওয়্যার ইউনিভার্সিটির আয়োজনে তিনি কথা বলেছিলেন পরীক্ষাভীতি প্রসঙ্গে। সেই কথামালার নির্বাচিত অংশ থাকল আজ।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
ছবি: প্রথম আলো

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পরিবেশ পাল্টায়, প্রযুক্তি পাল্টায়, বিজ্ঞান পাল্টায় কিন্তু মানুষের ভেতরটা তো পাল্টায় না। পরীক্ষা এমন এক জিনিস, যা মানুষ ভয় পাবেই। সেটা সে যেকোনো পরীক্ষাতেই বসুক না কেন! আমাদের সময় আমরা ভয় পেতাম, এখনো বাচ্চারা ভয় পায়।
আমি খুব ভালো ছাত্র ছিলাম না। সে জন্য আমার মধ্যে প্রথম হব না দ্বিতীয় হব, এমন কোনো ব্যাপার ছিল না। (তবু) ভয়-ভয় করত, কারণ, কোনো প্রস্তুতি ছিল না। সারা বছর দুষ্টুমি করে বেড়াতাম, পড়াশোনা করতাম না। ফলে পরীক্ষায় কী আসবে না আসবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। সারা বছর পড়াশোনা নেই। পরীক্ষার আগে আগে হয়তো মা–বাবা বকবে, সবার সামনে অপমানিত হতে হবে—এসব ভেবে পড়তে বসতাম। এই যে পরীক্ষাভিত্তিক পড়াশোনা, জিনিসটা খুব একটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ, মূল্যায়নটা হচ্ছে দুই-তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীরা কতটুকু মনে করতে পারে আর লিখতে পারে, তার ওপর ভিত্তি করে। এর মাধ্যমে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।

এই যে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরীক্ষা দিচ্ছে, এটা আমার বরাবর কেন যেন অবৈজ্ঞানিক মনে হয়। মানুষের মেধা অর্থাৎ সে কতটুকু পড়াশোনা করেছে, কতটুকু শিখেছে, কতটা সে আত্মীকরণ করেছে—এটা ওই দুই–তিন ঘণ্টার মধ্যে ঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ, অনেক সময় নার্ভাসনেস থেকে মানুষের ঠিক ওই মুহূর্তে একটা স্মৃতিভ্রম হয়, ফলে সব ভুলে যায়। আমার একবার হয়েছিল। আইএ পরীক্ষার সময় সারা রাত জেগে পড়ছিলাম, হঠাৎ নার্ভাস হয়ে গেলাম; তারপর দেখলাম সব ভুলে গেছি। পরের দিন ইতিহাস পরীক্ষা। কী পরীক্ষা দেব, বুঝতে পারছিলাম না। কোনো নাম মনে পড়ছে না, সাল মনে পড়ছে না, ঘটনা মনে পড়ছে না। গোটা ইতিহাস জিনিসটাই মাথা থেকে বের হয়ে গেল। তখন এক বন্ধু বলল, তুই আর পড়াশোনা করিস না, শুয়ে পড়। জোর করে আমাকে শুইয়ে দিল। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালবেলা উঠে কোনো চাপ নিলাম না। টোস্ট আর চা খেতে খেতে ইতিহাস বইটা একটু একটু করে উল্টে গেলাম।
তারপর পরীক্ষা দিতে গিয়ে লিখতে শুরু করলাম। তখন আমার ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে গেল। এটা তো আমার হঠাৎ করে নার্ভাসনেস থেকে হয়েছিল। একধরনের সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ থাকে। এটা যে কারোরই হতে পারে। আমি হয়তো এটা উতরে আসতে পেরেছিলাম, কিন্তু অনেকে সেটা না-ও করতে পারে। অনেকের অনেক শারীরিক-মানসিক অসুবিধা থাকে। সুতরাং আমাদের চিন্তাভাবনার যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাচ্চাদের ফেলে দেওয়াটা একেবারেই উচিত নয়। দুর্বল মনের ছেলেমেয়ে যারা আছে, হয়তো তারা মেধাবী, কিন্তু তাদের মনটা অতটা সবল নয়; তাদের কাছে পরীক্ষা ব্যাপারটা একটা জুয়া খেলার মতো। এই রকম একটা মানসিক চিন্তায় তাদের ফেলে দেওয়াটা, আমার মনে হয় না বিদ্যাচর্চার পক্ষে খুব একটা স্বাস্থ্যকর।

আগের দিনে পাঠশালায়, গুরুগৃহে ছাত্ররা পড়াশোনা করত। সারা দিন ধরে গরু চড়াত, সন্ধ্যাবেলায় এসে গুরুর কাছে বসত। তিনি পাঠ দিতেন। সেই পাঠ তারা মনে মনে গ্রহণ করত। এই যে ধীরে ধীরে শেখা, সেখানে পাস করা মানে গুরুর সার্টিফিকেট। গুরু বা শিক্ষক বললেন যে ‘ঠিক আছে, তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ।’ এটাই ছিল সে সময়ের স্নাতক বলো বা গ্র্যাজুয়েশন বলো, সেটার মতো।
এখন এই বিপুল ছাত্রসমাজ, লাখো ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। আমি যখন শিক্ষকতা করেছি, তখন দেখেছি, বাইরে বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে, ভেতর থেকে প্রশ্ন ফেলে দিচ্ছে, তারা সেই প্রশ্নের উত্তর সাপ্লাই করছে। সব মিলিয়ে একটা বীভৎস ব্যাপার। এই যে অস্বাস্থ্যকর একটা পরিবেশ, তার মূলে আছে এই পরীক্ষার নিয়ম। পরীক্ষা নেওয়ার নিয়মটাকে আমি কোনো দিনও সমর্থন করি না। কারণ, এতে কোনো শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন অসম্ভব।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
ছবি: প্রথম আলো


বিদেশে কখনো এ ধরনের প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা হয় না। ওখানে পরীক্ষাটা হয় ক্লাস অনুযায়ী। তাদের প্রতিদিনের, সপ্তাহের, মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থী কতটুকু উন্নতি করেছে, সেগুলোর রেকর্ড রাখা হয়। সারা বছর ফাঁকি দিয়ে, কিছুদিন পড়াশোনা করে কোনোরকমে যতটুকু মাথায় থাকবে, পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে আসা, এতে ছাত্রের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো হয় না এবং যদি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়, তাতে তার বিরাট ধাক্কাও লাগে। তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ে।
আমাদের পড়াশোনা শুধু পরীক্ষাভিত্তিক হবে কি না, তাতে একজন ছেলে বা মেয়ের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে কি না, এ নিয়ে যদি একটা সমীক্ষা বা গবেষণা হয়, তাহলে দেখা যাবে, শেখানোটা আসলে ধীরে ধীরে হয়। প্রতিদিন ওই একটা ছেলে বা মেয়ের পরীক্ষা নেওয়া, প্রতিদিন তার উন্নতিটা রেকর্ড করা, সে কতখানি শিখছে না শিখছে, ব্যক্তিগতভাবে সেটা জানার চেষ্টা করা। এভাবে যদি ধীরে ধীরে এগোনো যায় এবং পরীক্ষা ব্যাপারটি ধীরে ধীরে বাদ দিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সে শিখবে।
শিক্ষা গ্রহণ করা এবং পরীক্ষায় পাস করার জন্য শেখা, দুটোর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে। পরীক্ষায় কোনো না কোনোভাবে পাস করা যায়। কিন্তু পাস করে শেখা যায় না। শেখা এবং পাস করার মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে—এটা মানুষকে বুঝতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ যে রকম স্কুলের লেখাপড়া পছন্দ করতেন না, ফলে তিনি স্কুলে বেশি দিন থাকতে পারেননি। প্রথমত তাঁর সঙ্গি–সাথিদের পছন্দ হতো না। দ্বিতীয়ত তিনি একটা অবরোধ চান এবং সম্ভবত তিনি এই প্রাণান্তকর পরীক্ষায় পাস করার যে দড়ি–টানাটানি, সেটার মধ্যেও খুব একটা প্রবিষ্ট হতে চাননি। ফলে তিনি পরে গাছতলায় একটি স্কুল করলেন। সেই স্কুলে মাস্টারমশাইরা শেখান গাছতলায় বসে, প্রকৃতির মাঝখানে। সেখানে অবরোধটা হচ্ছে ঘর, চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ থাকবে না। অর্থাৎ আশঙ্কাজনক যা কিছু আছে, সেগুলো তিনি বাদ দিয়ে দিলেন। বাদ দেওয়ার ফলে বাচ্চারা প্রকৃতির কাছাকাছি এল। তারা হয়তো কাকের ডাক শুনছে, বকের ডাক শুনছে, মাঠে গরু চড়ছে, সেটা দেখছে, এর ভেতর কানে পড়াটাও আসছে। এর মাধ্যমে কোনোখানে যেন চাপটাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিবেশটা অন্য রকম। ফলে চাপটা নেই। আমার মনে হয়, সেখানে বোধ হয় মানসিক স্বাস্থ্যটা অক্ষুণ্ন থাকে। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষা ব্যাপারটিকে তাঁরা বাদ দিয়ে দিতে পারেননি, কিন্তু শেখানোর পরিবেশটা তাঁরা ধরে রাখতে পেরেছিলেন।

আমাদের দেশে যেমন বহুকাল ধরে একই রকম পরীক্ষা পদ্ধতি—সিলেবাস পাল্টাচ্ছে, কিন্তু পদ্ধতি পাল্টাচ্ছে না। ফলে যা যেভাবে হতো, সেভাবেই হচ্ছে। আমি তো অত বড় গবেষক বা চিন্তক নই, তবে এটা বুঝি যে এই পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত নয়। মানুষের চরিত্র আমি যতটুকু জেনেছি বা চিনেছি, এটা তার অনুকূল নয়। সুতরাং এটাকে বদল করার একটা চেষ্টা করা উচিত। চেষ্টা না করলে যেটা হবে, আরও বহুকাল ধরে আমাদের দেশের মানুষ পরীক্ষায় পাস করবে, কিন্তু শিখবে না। শেখার ব্যাপারটা আমাদের যেমন ছিল, তেমনই থেকে যাবে। যে ছেলে মফস্‌সলের একটা কলেজে বিএ, বিএসসি বা বিকম পড়ছে, সে জানে তার ভবিষ্যৎ কিছু নেই। সে পাস করে গেলেও চাকরি পাবে না। তার মানে এখনকার পড়াশোনা হচ্ছে চাকরিভিত্তিক।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, শিক্ষা, চাকরি, কর্মসংস্থান—এগুলোকে আমরা একই রাস্তার বলে মনে করে নিচ্ছি। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে, যেহেতু আমাকে কর্মসংস্থান দেওয়া হবে, তাই আমি শিখব। এই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে লেখাপড়া হবে, কিন্তু মানুষ শিক্ষিত হবে না। মানুষ যেমন ছিল, তেমনই থেকে যাবে। অনেক দিন আগে বিধান রায়ের কাছে কিছু মানুষ নালিশ করেছিলেন, ‘আপনার অফিসাররা ঘুষ খান।’ তখন বিধান রায় বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা সোনার মেডেল পাওয়া ছেলে, যারা খুব ভালো রেজাল্ট করে, সেসব সোনার টুকরো ছেলেকে আমি ডেকে এনে চাকরি দিয়েছি। এখন তারা যদি ঘুষ খায়, তাহলে আমি কার কাছে যাব?’
এখন কথা হচ্ছে, তারা ঘুষ খাচ্ছে কেন? তারা তো ভালো ছাত্র। আমরা যাদের শিক্ষিত বলি, তারা তা–ই। শিক্ষিত মানেই তারা শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সে শিক্ষা তার মনের কোনো রকম মলিনতা ঘোচাতে পারছে না। তার ভেতর চৌর্যবৃত্তি, লোভ-লালসা সব রয়ে গেছে। তাহলে মানুষ প্রশ্ন করতে পারে, এই শিক্ষার দাম কী? শিখে কী হবে?
কাজেই আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে মানুষ যখন বড় করে বা অন্যভাবে ভাবতে শিখবে, তখন তারা এই পরীক্ষা জিনিসটাকে অবশ্যই বিলুপ্ত করবে। শিক্ষাবিদেরা কখনো কখনো বলেছেন, আমাদের অন্য কোনো উপায়ও নেই, তাই আমরা এই জিনিসকে বাদ দিতে পারছি না। আমি তো খুব ঘোরাঘুরি করি, আমি দেখেছি, গ্রামের স্কুলের শিক্ষকেরা তেমন কিছু জানেন না, ছাত্রদেরও তেমন কিছু তাঁরা জানাতে পারেন না। এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি।
কীভাবে এর বিকল্প খুঁজে বের করা যায়, সে চেষ্টা কখনো করিনি। কিন্তু আমার মনে হয়, খুব ডেডিকেটেড শিক্ষাসমাজ এবং শক্তিশালী কোনো প্রক্রিয়া ছাড়া এই জিনিসকে বাদ দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু সেটা না করতে পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার নামে কিছু অশিক্ষিত লোক তৈরি করবে। প্রকৃত শিক্ষা কখনোই হবে না।
সূত্র: বক্তব্যের ভিডিও