হলুদের শত গুণ এবং একটি রেসিপি

হলুদের অনেক গুণ। নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিমাণ হলুদ খেলে আপনি সুস্থ থাকতে পারেন। ছবি: প্রথম আলো
হলুদের অনেক গুণ। নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিমাণ হলুদ খেলে আপনি সুস্থ থাকতে পারেন। ছবি: প্রথম আলো

তুরীণ তার ক্লাসে সবচেয়ে প্রাণবন্ত মেয়ে। সব সময় চোখে-মুখে যেন হাসি লেগে আছে। ছিপছিপে গড়ন। গায়ের রঙে যেন অদ্ভুত সোনালি দ্যুতি ছড়ায়। ওর প্রতি সবাই মুগ্ধ। ক্লাসের বন্ধুরা একদিন সবাই মিলে ওর এই সুন্দর ত্বকের রহস্য জানতে চায়। তুরীণ হাসি মুখে জানায়, ও প্রতিদিন সকালে এক টুকরা কাঁচা হলুদ ১ চামচ আখের গুড় দিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ২ গ্লাস কুসুম গরম পানি পান করে। এটাই নাকি ওর অভ্যাস। বন্ধুরা তো ওর সৌন্দর্যের রহস্য জেনে অবাক। আসলে অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার বটে—হলুদের যে অনেক গুণ!

আপনাদের আজ ‘মসলার রানি’খ্যাত হলুদের গুণের কথা শোনাব। হলুদের রং সোনালি। মনমোহিনী একটা ঘ্রাণও আছে তার। হাজার বছর ধরে সারা পৃথিবীর মানুষ রান্নার কাজে হলুদ ব্যবহার করে আসছে।

প্রথমে হলুদের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে কিছু তথ্য বলে রাখি। আমেরিকার কৃষি বিভাগের জাতীয় পুষ্টিগুণ তথ্যপঞ্জি মতে, ১ টেবিল চামচ হলুদগুঁড়ায় পাওয়া যায় ২৯ ক্যালরি, শূন্য দশমিক ৯১ গ্রাম প্রোটিন, শূন্য দশমিক ৩১ গ্রাম চর্বি, ৬ দশমিক ৩১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ২ দশমিক ১ গ্রাম আঁশ ও শূন্য দশমিক ৩ গ্রাম গ্লুকোজ। এ ছাড়া পাওয়া যায় দৈনিক চাহিদার ২৬ শতাংশ ম্যাংগানিজ, ১৬ শতাংশ আয়রন, ৫ শতাংশ পটাশিয়াম, ৩ শতাংশ ভিটামিন সি এবং সামান্য পরিমাণ ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, ক্যালসিয়াম, কপার ও জিংক। এত সব পুষ্টি উপাদানের উপকারিতা বিচারে হলুদকে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার অন্যতম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

হলুদে পুষ্টিগুণ তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে বিভিন্ন রোগপ্রতিরোধকারী ক্ষমতা।

কাঁচা হলুদ রূপচর্চায় ব্যবহার করা যায়। ছবি: প্রথম আলো
কাঁচা হলুদ রূপচর্চায় ব্যবহার করা যায়। ছবি: প্রথম আলো

ক্যানসার প্রতিরোধে হলুদ
হলুদে কারকিউমিনের উপস্থিতির কারণে হলুদ প্রোস্টেট ক্যানসার, প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার, মাল্টিপ্লাই মায়োলেমা জাতীয় ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক বলে ধারণা করা হয়। হলুদের কারকিউমিন ক্যানসার কোষগুলোর বৃদ্ধি প্রতিহত করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এ ছাড়া রেডিয়েশনের কারণে সৃষ্ট টিউমারের বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ উপায়ে প্রতিহত করতে পারে হলুদ।

আর্থ্রাইটিস থেকে মুক্তিলাভ
অস্টিও আর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের প্রকোপ কমাতে হলুদের ব্যথা নিবারক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। হলুদের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণের কারণে ক্ষতিকর ফ্রি রেডিকেলগুলো ধ্বংস হয় বলে আমাদের দেহের কোষগুলো সুস্থ থাকে। যাঁরা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন, তাঁরা যদি নিয়মিত একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় হলুদ খাওয়া শুরু করেন, একপর্যায়ে তাঁদের এই জয়েন্ট পেন অনেকটাই কমে যাবে।

রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
হলুদের লাইপোপলিস্যাকারাইড দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এর অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল এজেন্ট প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। এরূপ শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠান্ডা, সর্দি, কাশি হওয়ার প্রবণতাকে রোধ করে।

সুস্থ ও কর্মক্ষম যকৃতের জন্য চাই হলুদ
হলুদ মানবদেহে কিছু গুরুত্বপূর্ণ এনজাইমের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। এই এনজাইমগুলো শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে যকৃতে আসা বিষাক্ত পদার্থগুলোকে ভেঙে দেয় এবং রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত করে শরীর থেকে বের হতে সাহায্য করে। এভাবে হলুদ রক্তপ্রবাহকে সতেজ ও উন্নত করে, যা যকৃতের সুস্থতার জন্য সহায়ক।

খাদ্য পরিপাক ও অতিরিক্ত ওজন কমাতে সহায়ক
নিয়মিত ক্ষয়রোধ ও প্রদাহ রোধ করে খাদ্যনালির সুস্থতা নিশ্চিত করে হলুদ। আইবিএসের (Irritable bowel syndrome) আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় হলুদের ভূমিকা অনন্য। গ্যাসের কারণে পেট ফুলে যাওয়াকে প্রতিহত করে হলুদ।

হলুদ পিত্তরসের নিঃসরণ বাড়িয়ে দিয়ে খাদ্যে অবস্থিত চর্বিকে ভাঙতে সহায়তা করে। যাঁরা ওজন কমাতে ইচ্ছুক, তাঁরা প্রতিবার খাবার সময় ১ চা-চামচ পরিমাণ হলুদগুঁড়া খাবারের সঙ্গে খেলে উপকার পেতে পারেন।

হলুদের অ্যান্টিসেপ্টিক গুণাবলি
প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপ্টিক ও অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে হলুদ যেকোনো সংক্রমণকে প্রতিহত করে। শরীরের কোনো কাটা বা পোড়া ক্ষত স্থানে হলুদ লাগিয়ে দিলে দ্রুত ক্ষত পূরণ হয়ে যায়।

বার্ধক্যে আলঝেইমার ডিজিজ প্রতিরোধে হলুদ
ধারণা করা হয়, মস্তিষ্কের প্রদাহের কারণে বৃদ্ধ বয়সে অনেকের আলঝেইমার রোগ হয়। এ রোগে বোধশক্তি কমে যায়। হলুদের প্রদাহবিরোধী গুণের কারণে মস্তিষ্কে সৃষ্ট প্লাক ভেঙে গিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ উন্নত হয়। তাই এই রোগ দেরিতে দেখা দেয় বা অনেকাংশে প্রতিহত হয়।

সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় গ্রহণ করতে হয়। না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। হলুদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। তাই মাত্রাতিরিক্ত হলুদ গ্রহণের কুফলও জেনে রাখুন।
১. হলুদ পাকস্থলীর গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড নিঃসরণকে বাড়িয়ে দেয়, ফলে কারও কারও ক্ষেত্রে উপকার হলেও কারও ক্ষেত্রে বিপরীত প্রতিক্রিয়াও দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
২. বিশুদ্ধকরণ গুণের কারণে হলুদ রক্তকে তরল রেখে রক্তনালির মধ্য দিয়ে রক্তের প্রবাহকে সহজ করে। যাঁদের রক্তচাপ কম, তাঁদের আলাদা করে বেশি মাত্রায় হলুদ না খাওয়াই ভালো। যাঁরা নিয়মিতভাবে রক্ত তরলকারী ওষুধ সেবন করে আসছেন, তাঁদেরও আলাদা করে ওষুধ আকারে হলুদ খাওয়া ঠিক হবে না।
বিভিন্নভাবে হলুদ খাওয়া ও ব্যবহার করা যায়।
১. গুঁড়া হলুদ রান্নায় ব্যবহার করে,
২. ক্যাপসুল আকারে,
৩. কাঁচা হলুদ টুকরা করে কেটে আখের গুড় দিয়ে মেখে খাওয়া যায়,
৪. রূপচর্চায় বাটা হলুদ ব্যবহার করা যায়।

হলুদের সর্বোচ্চ উপকার পাওয়ার জন্য আপনি নিয়মিত ‘হলুদ চা’ পান করতে পারেন।

যেভাবে হলুদ চা তৈরি করবেন

উপকরণ
১ কাপ পানি, আধা চা-চামচ হলুদগুঁড়া, ১ চা-চামচ মধু (স্বাদের জন্য)।

প্রস্তুত প্রণালি

১ কাপ হালকা গরম পানিতে পরিমাণমতো হলুদগুঁড়া ও মধু ভালোমতো মিশিয়ে নিলেই হয়ে যাবে হলুদ চা। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এই চা পান করার অভ্যাস করলে অনেক ভালো ফল পাওয়া যাবে।

গুঁড়া হলুদ বাজার থেকে না কিনে বাড়িতেই তৈরি করা সম্ভব। প্রথমে তাজা রসাল কিছু হলুদ কিনে ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। তারপর হলুদ কন্দ চাক চাক করে কেটে ভালো ভাবে রোদে শুকিয়ে ব্লেন্ডারে গুঁড়া করে নিলেই হলো। যদি মিহি গুঁড়া পেতে চান তবে পাতলা চালনি দিয়ে চেলে নিতে পারেন।

এত যার উপকার সেই হলুদকে সঠিক মাত্রায় গ্রহণ করলে আপনি যে সুস্থ, সুন্দর নীরোগ জীবনের অধিকারী হবেন, এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যায়। ক্ষতি কী! দেখুন না চেষ্টা করে।

লেখক: পুষ্টি ও খাদ্য পরামর্শবিদ