সম্পর্ক মূলত দুজন ব্যক্তিকে আবেগ, ভালোবাসার মাধ্যমে মানসিকভাবে যুক্ত করে। সম্পর্কের ভালোবাসা আমাদের যোগ্যতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী করে। অন্যের কাছে প্রাধান্য, যেকোনো প্রয়োজনে পাশে পাওয়ার নিশ্চয়তা, সঙ্গীর জীবনে নিজের গুরুত্ব আমাদের শুধু আনন্দিতই করে, তা–ই নয়; আমাদের মনে এক গভীর নিরাপত্তাবোধ দেয়, উদ্বেগ কমায়, জীবনের ছোট-বড় নানা সমস্যা মোকাবিলা করা সহজ করে। ইতিবাচক দাম্পত্যে ব্যক্তিকে উজ্জীবিত ও জীবনমুখী করে, কর্মস্পৃহা বাড়ায়।
পজিটিভ সাইকোলজির প্রবক্তা মার্টিন সেলিগম্যান ব্যক্তির ভালো থাকা বা সুখের যে পাঁচটি স্তম্ভের কথা বলেছেন, তার মধ্যে ‘সম্পর্ক’ অন্যতম। গুণগত জীবন যাপনের জন্য এই পাঁচটি স্তম্ভ গুরুত্বপূর্ণ হলেও অন্য গবেষণায়ও দেখা গিয়েছে, ‘ইতিবাচক সম্পর্ক’ সুখের অন্যতম প্রধান নির্ধারক।
সুস্থ সম্পর্ক বুঝতে...
সুস্থ সম্পর্ক সেটাই যেখানে দুজন সঙ্গী
*পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে সন্তুষ্ট, পরিতৃপ্ত ও সুখীবোধ করে
*পরস্পরের কাছে নিরাপদ এবং আরামদায়ক বোধ করবে
*পরস্পরের প্রতি আচরণ সম্মানপূর্ণ হবে
*নিজেদের সঙ্গে কাটানো সময় আনন্দপূর্ণ হবে
*পরস্পরের জীবনের প্রতি আগ্রহ থাকবে (যেমন: বন্ধুবান্ধব, ভালো লাগার বিষয়, পরিবার, জীবন নিয়ে ভাবনা, স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি)
*পরস্পরের প্রতি আস্থা/বিশ্বাস থাকবে
*পারস্পরিক ভালোবাসা, মমতা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদির ভিত্তিতে পরস্পরকে প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।
কেন প্রয়োজন সম্পর্কের সুস্থতা?
*ইতিবাচক সম্পর্ক যেমন সঙ্গীদের জীবনে ইতিবাচক কর্মশক্তি, সক্রিয়তা যোগ করে। তেমনি রোমান্টিক সম্পর্কের গুণগত উপাদানগুলোর অভাব ব্যক্তিকে করে তুলতে পারে চরম অসুখী, অনুৎপাদনশীল।
*সম্পর্কের নেতিবাচকতা আমাদের নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমায়
*হীনম্মন্যতা তৈরি হয়
*নিরাপত্তাহীনতা, উদ্বেগ ও অস্থিরতা বাড়ায়
*কর্মস্পৃহা কমায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে জীবনবিমুখী করে তুলতে পারে।
*গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সম্পর্ক থাকা না–থাকার তুলনায় সম্পর্কের গুণগত মানের ওপর ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, জীবন যাপনে সন্তুষ্টি, সঙ্গী ও সন্তানদের ভালো থাকা নির্ভরশীল (কামিং অ্যান্ড ডেভিস, ২০১১; ব্যারেট ২০১১)। গবেষণা বলছে, অসুখী দাম্পত্যের নেতিবাচক প্রভাব ব্যক্তির নিজের এবং তাঁর সন্তানদের ওপর সুদূরপ্রসারী।
সম্পর্কের গুণগত মান বাড়াবেন কীভাবে?
যেকোনো আবেগময় সম্পর্ক একধরনের বেড়ে ওঠা গাছের মতো, যা সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন প্রতিদিনের পরিচর্যা। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক আবেগ, ভালোবাসা, আকর্ষণ, নির্ভরশীলতা এমনি এমনি বেড়ে উঠবে না। এর জন্য প্রয়োজন দুজনের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও এর গুরুত্ব অনুধাবন!
সময় দিন: প্রতিদিন ‘অল্প’ হলেও শুধু দুজনের জন্য কিছুটা সময় রাখুন। এ সময়ে পরস্পরের সঙ্গ উপভোগের চেষ্টা করুন, মজা করুন, পরস্পরের খোঁজখবর নিন, তার সারা দিনের কর্মব্যস্ততা ইত্যাদি নিয়ে পারলে কথা বলুন, গল্প করুন। অল্প সময়ের জন্য হলেও সঙ্গীর নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ এবং প্রাধান্য নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে সাহায্য করে, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
সম্মান করুন: গুণগত সম্পর্কের অন্যতম নির্ধারক পারস্পরিক সম্মান। আচরণ, কথায়, অন্যের কাছে প্রকাশে সঙ্গীর আত্মসম্মানের দিক খেয়াল রাখুন।
প্রশংসা করুন: প্রতিদিন ছোটখাটো নানা ভালো কাজে প্রশংসা করুন। অন্যের প্রশংসা বা স্বীকৃতি আমাদের উৎসাহিত করা ছাড়াও আমাদের ভালো দিকগুলোর প্রতি যে সঙ্গী মনোযোগী তা প্রমাণ করে।
স্নেহ প্রকাশ করুন: প্রতিদিন নানাভাবে (স্পর্শের মাধ্যমে, মৌখিকভাবে) আপনার মমতা, স্নেহ সঙ্গীকে প্রকাশ করুন। প্রতিটা মানুষেই নানা ধরনের ‘নাজুকতা’ মধ্যে দিয়ে যায়। প্রিয়জনের স্নেহময় ‘আশ্রয়’ আমাদের নাজুকতা মোকাবিলা করতে সাহায্য করে।
বেড়াতে যান: কর্মব্যস্ততা থাকলেও সপ্তাহে অন্তত একবেলা আপনার সঙ্গীর জন্য রাখুন। একসঙ্গে বাইরে বের হন, ঘুরুন, একসঙ্গে ভালো লাগার কিছু উপভোগ করুন। একান্তে কাটানো এ সময় সমস্যা নিয়ে কথা না বলে ইতিবাচক বিষয় নিয়ে কথা বলুন। ছোট ছোট এ ধরনের অভ্যাস সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনতে সাহায্য করে, ক্লান্তি দূর করে।
দ্বন্দ্ব মোকাবিলায় কৌশলী হোন: রোমান্টিক বা আবেগময় সম্পর্কে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভালো কিছুর সঙ্গে নানা অপ্রাপ্তি, দ্বন্দ্ব, অপ্রত্যাশিত বিষয় যোগ হবে। অযথা প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বা মনের মধ্যে না পুষে সরাসরি করে কথা বলুন। এমনভাবে বলবেন না, যাতে অপর পক্ষ চ্যালেঞ্জ বোধ করে বা নিজেকে ছোট মনে করে। প্রয়োজনে সঙ্গীর ব্যক্তিত্বে কিছু সীমাবদ্ধতা যা খুব একটা পরিবর্তন করতে পারবেন না, সেটা গ্রহণ করুন। সে ক্ষেত্রে তার ভালো বিষয়গুলো এবং সম্পর্কের শক্তিশালী দিকগুলো বেশি করে মাথায় রাখুন।
খোলামেলা কথা বলুন: ভালোবাসা, সততা, স্বচ্ছতা, বিশ্বাস, দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে দাঁড়ানো সম্পর্ক পরস্পরকে যে নির্ভরতা দেয় এবং যেভাবে নির্ভার করে সেটা দীর্ঘ জীবনের পথ চলার নানা জটিলতা অনেক সহজ করে দেয়। পরস্পরের সঙ্গে খোলামেলাভাবে কথা বলা, রসবোধ রাখা, নিজের মতামতের বাইরে অন্যের মতামত গ্রহণ করার মানসিকতা রাখুন।
সম্পর্কে বন্ধুত্ব: দাম্পত্যে বন্ধুত্ব যোগ হলে এর স্থায়িত্ব বাড়ে। কাজেই পরিবার, শৈশব, অতীত, আগ্রহ ও কাজের বিষয়, জীবন সম্পর্কে ভাবনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি নানা কিছু শেয়ার করুনএবং তার বিষয়ে আগ্রহ দেখান।
একান্ত সময়: নিজের ব্যক্তিগত জায়গা (পারসোনাল স্পেস) রাখুন। নিজের ভালো লাগার বিষয় চর্চা করুন, নিজস্ব বন্ধুবান্ধব রাখুন, আত্মনির্ভরশীল হন। সঙ্গীর প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা থেকে বিরত থাকুন।
সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় যেসব কারণে
*ছোট করে কথা বলা, সমালোচনা করা
*সবকিছুতে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা বা নিজের সুবিধায় ব্যবহার করা
*ছোটখাটো চাহিদা, আগ্রহ উপেক্ষা
*আত্মসম্মানে আঘাত লাগে এমন আচরণ
*পরিবার নিয়ে হেয় করে কথা বলা।
মেখলা সরকার, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা