চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ১৪৯ জন, অর্থাৎ গড়ে মাসে ১৬ জনের বেশি নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন। আর স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে খুন হয়েছেন ৩৪ জন। এর বাইরে পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেন ৩৯ জন নারী। এ ছাড়া শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন তো ছিলই।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জাতীয় ১২টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের তথ্য নিয়ে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদন’-এ এই চিত্র তুলে ধরেছে।
আসকের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, আসকের এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে। এর বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটছে। জেলা পর্যায়ের বাইরে সাইনবোর্ড-সর্বস্ব মানবাধিকার সংগঠন ছাড়া কোনো মানবাধিকার সংগঠন কাজ করছে না। পত্রিকায় প্রকাশ তো দূরের কথা, তখন তথ্য পর্যন্ত জানা যাচ্ছে না। সব হিসাব পাওয়া গেলে খুনের সংখ্যা আরও বাড়বে।
পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে সরকার ২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন করেছে। বিভিন্ন বেসরকারি নারী ও মানবাধিকার সংগঠন এ নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করছে। তারপরও শুধু স্বামী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হাতে খুনের পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক বলে বলছেন এসব সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
দেশে ২০০৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক সংগঠন অক্সফামের সহায়তায় বাংলাদেশে চলছে ‘উই ক্যান’ বা ‘আমরাই পারি’ প্রচারাভিযান। ৪৮টি জেলায় এ প্রচারাভিযানের আওতায় পারিবারিক নির্যাতনকে চ্যালেঞ্জ করার ইচ্ছা বা মনোবল আছে এবং কাজ করছেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এ ধরনের ‘চেঞ্জমেকার’ আছেন ১০ লাখ। তাঁরা এলাকায় পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে প্রথমে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলে মানবাধিকার সংগঠনের কাছে পাঠান। এ প্রচারাভিযানে প্রায় ৫০ শতাংশ সদস্যই পুরুষ। এই পুরুষদের অনেকেই একসময় নিজেরাই নির্যাতনকারীর ভূমিকায় ছিলেন।
পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ‘আমরাই পারি’র কো-চেয়ার এম বি আখতার প্রথম আলোকে বলেন, শুধু পুরুষের মধ্যে পরিবর্তন আনলেই হবে না, নারীর নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করতে হবে। নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে হবে নারীকে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) লিঙ্গীয় পরিচয় (জেন্ডার) এবং নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে পুরুষের মনোভাব ও চর্চাবিষয়ক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্রামের ৮৯ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, স্ত্রী অন্যায় কিছু করলে স্বামীর মার দেওয়ার অধিকার আছে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই শহরের পুরুষেরাও, তাঁদের ক্ষেত্রে এ হার ৮৩ শতাংশ। এ ছাড়া শহরের ৯৩ শতাংশ এবং গ্রামের ৯৮ শতাংশ পুরুষই বিশ্বাস করেন, পুরুষ হতে হলে তাঁকে কঠোর হতেই হবে। আবার শহরের ৫০ শতাংশ এবং গ্রামের ৬৫ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, পরিবারকে রক্ষা করার জন্য নারীদের নির্যাতন সহ্য করা উচিত। ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে ২ হাজার ৪০০ জন পুরুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ জরিপ চালানো হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক দ্বিতীয় জরিপের ফলাফল বলছে, বর্তমানে বিবাহিত নারীদের ৮০ শতাংশই জীবনে অন্তত একবার স্বামীর হাতে কোনো-না-কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর বেশির ভাগ নারী (৭২ দশমিক ৭ শতাংশ) কখনোই নির্যাতনের কথা কাউকে জানাননি।
এম বি আখতার বলেন, পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে আইন আছে। তবে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ থানায় গেলে থানার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পরামর্শ দেন, সংসার করতে গেলে মানিয়ে চলাই ভালো। আইনি ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নেই। আইনের মাধ্যমে যে সুরক্ষা পাওয়ার সুযোগ, তা পাচ্ছেন না নারীরা।
নূর খানের মতে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অস্থিরতার প্রভাবে সহিংসতা বাড়ছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারীরা সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য প্রথমে সমঝোতা করলেও সে সমঝোতা বেশি দিন টেকে না। তারপর আইনি আশ্রয় নিলে মামলার দীর্ঘসূত্রতায় বাদীপক্ষ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।