ফাহাদের কয়েনের জাদুঘর

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ নাঈম আল তাহসীন নিজের সংগ্রহের কয়েন দেখাচ্ছেন l প্রথম আলো
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ নাঈম আল তাহসীন নিজের সংগ্রহের কয়েন দেখাচ্ছেন l প্রথম আলো

পুকুরে গোসল করার সময় বন্ধুরা কাদা ছোড়াছুড়ি করছিল। কোনো এক বন্ধু ছুড়ে দেওয়া একদলা কাদা এসে পড়ে ফাহাদের কাছে। কাদার দলার মধ্যে পেয়ে যান একটি দুর্লভ কয়েন। এরপর সবাই মিলে কোদাল দিয়ে পুকুরের মাটি তুলে সেখানে আরও পাঁচটি পাকিস্তান আমলের কয়েন খুঁজে পান।

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা নাঈম আল তাহসীন ওরফে ফাহাদের ঝুলিতে এমন অনেক মজার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর এসব অভিজ্ঞতার বেশির ভাগই কয়েনসংক্রান্ত। চট্টগ্রাম ইনস্টিটিউট অব বিজনেস স্টাডিজ কলেজের বিবিএর ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র ফাহাদ দেশি-বিদেশি কয়েন, কাগজের মুদ্রা ও স্ট্যাম্পের সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন। ১৩৮ থেকে ১৬১ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট এন্টোনিয়াস পায়ামের কয়েন থেকে শুরু করে নবীন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের কয়েনও রয়েছে তাঁর কাছে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, বায়াফ্রা, ফিউম, ইউনিয়ন আইল্যান্ডসহ বিশ্বের তিন শতাধিক দেশের প্রচলিত ও অপ্রচলিত দেড় হাজার কাগুজে ও ধাতব মুদ্রা রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। পাশাপাশি রয়েছে দেড় হাজার স্ট্যাম্প। কয়েন সংগ্রহের সূত্রে ভিনদেশি অনেক বন্ধুও হয়েছে তাঁর।

মাটিরাঙ্গা উপজেলার চৌধুরীপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফাহাদ চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। ফহাদের বাবা পুলিশ কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক একসময় ছেলের এ সব কর্মকাণ্ডে বিরক্ত ছিলেন। কিন্তু এখন সংগ্রহশালা দেখে নিজেই অবাক হন। ছেলের জন্য গর্বও হয় তাঁর।

সম্প্রতি মাটিরাঙ্গার চৌধুরীপাড়ায় গেলে দেখা হয় ফাহাদের সংগ্রহশালা। বেশ কয়েকটি অ্যালবামে কাগজের নোট ও কয়েনগুলো যত্ন করে সাজানো। সুদৃশ্য কাগজের নোটগুলো যেন একেকটি শিল্পকর্ম। কীভাবে শুরু হলো কয়েন সংগ্রহ?

জানতে চাইলে ফাহাদ জানান, ‘২০০৭ সালের কথা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় দুই সহপাঠীর কাছে কয়েন দেখি। তারা কয়েন সংগ্রহ করত। তাদের দেখে আমারও কয়েন সংগ্রহের ইচ্ছে জাগে। এরপর টিফিনের টাকা ও গাড়িভাড়া থেকে টাকা জমানো শুরু করি। এসব দিয়ে কয়েন কিনি। পাশাপাশি ঈদের সময় পাওয়া সালামির টাকা দিয়েও কয়েন সংগ্রহ করতে থাকি।’

দীর্ঘ নয় বছরের চেষ্টায় আজ তাঁর বিশাল সংগ্রহশালা। শুরুর দিকে নানা বিড়ম্বনা হলেও কোনো বাধাই রুখতে পারেনি তাঁকে। ফাহাদ জানান, তার প্রথম সংগ্রহ ছিল ভারতীয় এক রুপি। তবে এখন তাঁর সংগ্রহে বহু দেশের মুদ্রা রয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকার এক মিলিয়ন ডলার এবং জিম্বাবুয়ের ১০ বিলিয়ন ডলারের রেপ্লিকাও রয়েছে। এ ছাড়া প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার প্রচলিত মুদ্রা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্রিটিশ–ভারত এবং সুলতানি আমলের ধাতব মুদ্রা। পাকিস্তান আমলের এবং বর্তমান বাংলাদেশের অনেক বিলুপ্ত মুদ্রা ও হাতের প্রুফ কয়েনও রয়েছে তার ভান্ডারে। কয়েন সংগ্রহ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে ফাহাদের। পেয়েছেন দেশি–বিদেশি অনেক বন্ধু। বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশের নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠেছে তাঁর। এদের কাছ থেকে কয়েন সংগ্রহের পাশাপাশি কয়েনসংক্রান্ত নানা তথ্যও পান তিনি। কিন্তু প্রথম অবস্থায় কয়েন সংগ্রহে যে সবচেয়ে সাহায্য করেছিল সেই বন্ধু ‘ইমন’ আজ পৃথিবীতে নেই।

কয়েন সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কেও ধারণা পাচ্ছেন ফাহাদ। তিনি বলেন, একটি মুদ্রা একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। তাই সংগ্রাহকেরা মুদ্রা দেখে দেশটি সম্পর্কে ধারণাও পান।

শৌখিন মুদ্রা সংগ্রাহক সবার প্রচেষ্টায় ভবিষ্যতে একটি মুদ্রার জাদুঘর গড়ে তুলতে চান। আগামী প্রজন্মের জন্য তুলে ধরতে চান নানা দেশের কয়েনের ভান্ডার।

ফাহাদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমিও ছোটবেলায় কয়েন জমা করতাম। কিন্তু শুরুর দিকে ছেলেকে মুদ্রা সংগ্রহে উৎসাহ দিইনি। ছেলের এমন শখ দেখে এখন সহযোগিতা দিচ্ছি।’

ফাহাদের বাবা পুলিশ কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘প্রথমে আমি ছেলের এমন কাণ্ড দেখে হতাশ হয়েছিলাম। শাসনও করেছি প্রচুর। কিন্তু এখন আমি ফাহাদের বাবা হিসেবে গর্বিত।’

 মাটিরাঙ্গা ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রশান্ত ত্রিপুরা বলেন, ‘আমাদের কলেজের ছাত্র ফাহাদ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমরা সবাই গর্ববোধ করি ফাহাদকে নিয়ে। তার কাছ থেকে বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষা নেওয়া উচিত।’