চট্টগ্রামের বইয়ের ডালি
‘চট্টগ্রামের তরুণ লেখকদের ভিত্তিটা তৈরি করে দেয় এখানকার প্রকাশনা সংস্থাগুলো। এখানে যাঁরা লেখালেখির চর্চা করেন, শুরুতে তাঁদের প্রধান আশ্রয় তো স্থানীয় প্রকাশনাগুলোই। তারপর ধীরে ধীরে তাঁরা ঢাকার প্রকাশকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেই হিসেবে চট্টগ্রামের প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে লেখক তৈরির সূতিকাগার বলা যায়। আমার নিজেরও শুরুটা হয়েছে চট্টগ্রামের শৈলী প্রকাশনার মাধ্যমে।’
নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো বললেন কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস। তাঁর কথা অনুযায়ী চট্টগ্রামের প্রকাশনাগুলোকে আঁতুড়ঘরই বলা যায়। এ শহরের বহু প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের প্রথম বই এখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই প্রকাশ করার দিকেই দেশের বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ঝোঁক। চট্টগ্রামের চিত্রটা কিন্তু ভিন্ন। এখানকার প্রকাশনা সংস্থাগুলো প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নবীন লেখকদের বই অনেক বেশি হারে প্রকাশ করছে। তবে এর পরও এখানকার প্রকাশনাগুলোর প্রসার বাড়ছে। প্রতিবছর প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় চোখ বোলালেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়।
শৈলী প্রকাশনের কথাই ধরা যাক। এবার এই প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে ৩৫টি বই। প্রকাশনার কর্ণধার শিশু সাহিত্যিক রাশেদ রউফ বলেন, ‘প্রতিবারের মতো নবীন লেখকদের উৎসাহ দিতে আমরা তাঁদের বই করছি।’ তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে আনোয়ারা আলমের ছোটদের বই রাজকুমার ও রূপাঞ্জল, বিমল গুহর টুপুর ও চরকাবুড়ি, আকতার হোসাইনের ছড়ার বই মেঘের কি বাড়ি নাই, দীপক বড়ুয়ার জাম্বু ভূতের কাণ্ড, মুহাম্মদ আমানুল্লাহর চড়ুইভাতির লালটিপ, জাহেদ মোতালেবের মুড়ি বুড়ি, জিন্নাহ চৌধুরী ছড়ার বই কোন পথে যায় তারা, রাশেদ রউফের কবিতার বই এসো পঞ্চাশে এসো মন চাষে, অধ্যাপক তৌহিদ আহমদের আত্মজীবনী মম জীবন যৌবন, আতাউল হাকিমের একান্ত ব্যক্তিগত, মো. রেজাউল করিমের প্রবন্ধের বই বাংলাদেশের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা উল্লেখযোগ্য।
বলাকা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ৬৫টি বই। এই প্রকাশনা সংস্থার অন্যতম কর্ণধার জামাল উদ্দিন জানান, এবার বাংলাদেশের বাইরে ভারতের বেশ কিছু লেখকের বইও প্রকাশ করছে বলাকা। প্রকাশিত বইগুলো ইতিমধ্যে জাতীয় বইমেলার ৪০০ নম্বর স্টলে শোভা পাচ্ছে। বলাকা প্রকাশিত এবারের বইয়ের তালিকায় আছে আবুল মনসুর আহমেদের জীবন সে-তো জীবনের তরে, জামাল নজরুল ইসলামের প্রবন্ধের বই সমাজ দর্পণ বিজ্ঞান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, ভবানী মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধের বই বিশ্ব সাহিত্যের লেখক, শরীফা বুলবুলের লেখা জীবনী গ্রন্থ অবিনাশী হুমায়ুন আজাদ, সিদ্ধার্থ সিংহের শিশুতোষ গল্পের বই বড় মামার বাঘ শিকার, মাহফুজুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এবং ধানমন্ডি থেকে বাংলাদেশ, নূর মোহাম্মদ রফিক সম্পাদিত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, জামাল উদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া নন্দন প্রকাশন জামাল উদ্দিনের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চাকমা জাতি, চট্টগ্রাম পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় সহ ২১টি বই প্রকাশ করছে।
আবির প্রকাশনের কর্ণধার মুহম্মদ নুরুল আবসার জানান, এই প্রকাশনা থেকে এবার নয়টি বই বেরিয়েছে। এর মধ্যে মুহম্মদ নুরুল আবসারের লেখা জীবনী গ্রন্থ শূন্য থেকে পূর্ণ, সিদ্দিক আহমেদ সম্মাননা স্মারক, ডা. গৌতম দাশগুপ্তের স্বাস্থ্য বিষয়ক বই সুস্বাস্থ্য সবসময়, আমিনুর রশীদ কাদেরীর প্রবন্ধের বই ক্যামেলিয়ার সবুজ রাজ্যে, রমজান আলী মামুনের কিশোর গল্পের বই কিশোর নেমেছে যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য।
শব্দশিল্প প্রকাশন প্রকাশ করেছে মানজুর মুহাম্মদের দুটো ছড়ার বই লাল পুতুলের ছড়া এবং আয় না ওরে টিয়ে।
কালধারা প্রকাশনী থেকে এবার ১৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে বলে জানালেন সত্ত্বাধিকারী শাহাবুদ্দিন। এর মধ্যে ফাহমিদা আমিনের প্রবন্ধের বই সামনের কথা সময়ের কথা, রফিক আনোয়ারের লেখা জীবনালেখ্য তোতা ময়না, মানজুর মুহাম্মদের ছড়ার বই আজ পুতুলের বিয়ে, রফিক আনোয়ারের উপন্যাস দুঃখ জাগানিয়া ও রক্ত নদী জলটুঙ্গি, নিতাই সেন সম্পাদিত দুই বাংলার ছড়া ও কবিতা, এস এম ওবায়দুল্লাহর তিস্তা নদীর নামে গ্রাম উল্লেখযোগ্য।
ছোটদের জন্য মানজুর মুহাম্মদের ছড়ার বই ছা ডিম ডিম ছা প্রকাশ করছে শৈশব প্রকাশনী।
ছোট কাগজ খড়িমাটির সম্পাদক কবি মুনিরুল মুনির জানালেন, তাঁরা এবার ১০টি বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্যে আবু মুসা চৌধুরীর কবিতার বই হে সুসমাচার , হোসাইন কবিরের কবিতার বই সাঁকোর নিচে শান্ত জল, আলেক্স আলীমের ছড়ার বই সাপ তুলেছে ফনা, শৈবাল চৌধুরীর সঙ্গীত বিষয়ক বই তিনি ঝড়ের কাছে লিখে গেছেন নাম, মনিরুল মনিরের কবিতার বই মাতাল দরজা উল্লেখযোগ্য ।
বাতিঘর প্রকাশনা এবার প্রকাশ করছে মানজুর মুহাম্মদের ছড়ার বই নেবুর বনে জোনাকি। পঙ্খীরাজ প্রকাশনীও ছন্দে ছড়ায় নাচ্ছে চড়াই নামে মানজুর মুহাম্মদের একটি ছড়ার বই প্রকাশ করছে। কবি হাফিজ রশিদ খানের কাব্যগ্রন্থ রোদের পোস্টার প্রকাশ করেছে প্রত্যালীঢ নামে একটি নতুন প্রকাশনা।
চট্টগ্রামের বাইরের প্রকাশনা : চট্টগ্রামে বসবাসরত অনেক লেখকের বই এবার ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করেছে। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলাদাসের উপন্যাস আমি মৃণালিনী নই প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন, প্রতিদ্বন্দ্বী নামে তাঁর আরেকটি উপন্যাস বের করেছে মওলা ব্রাদার্স।
এ ছাড়া হরিশংকর জলদাসের দশটি গল্প নিয়ে অন্যপ্রকাশ বের করেছে হরকিশোরবাবু। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে নার্গিসের প্রণয় কাহিনি নিয়ে লেখা বিশ্বজিৎ চৌধুরী উপন্যাস নার্গিস প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। ঢাকার ব্রেইন চাইল্ড প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে খালিদ আহসানের কবিতার বই কলম লিখেছে কবিতা আমি তার প্রথম শ্রোতা। এ ছাড়া তাঁর আরও একটি কাব্যগ্রন্থ বর্ণ চক্ষু অন্তঃকরণ প্রকাশ করেছে ঠোঙ প্রকাশন। সংবেদ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ওমর কায়সার ও বিশ্বজিৎ চৌধুরীর নির্বাচিত কবিতা নামে দুটো বই।
কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে এবার মেলায়। তাঁর উপন্যাস দেশ-বাড়িঃ শাহবাগ প্রকাশ করেছে শুদ্ধশ্বর, গল্পগ্রন্থ ভালোবাসা সনে আলাদা সত্য রচিত হয় প্রকাশ করেছে জোনাকি ও সাক্ষাৎকার সংকলন কথার কথা প্রকাশ করেছে আগামী। ভাগ্যধন বড়ুয়ার কবিতার বই অপর পৃষ্ঠার বৃত্তান্ত প্রকাশ করেছে পাঠসূত্র, দিলীপ কির্ত্তুনিয়ার কাব্যগ্রন্থ যেখানে খুব একা প্রকাশ করেছে শুদ্ধস্বর, ফারহানা আনন্দময়ীর কাব্যগ্রন্থ ইচ্ছেসবুজ প্রকাশ করেছে শুদ্ধস্বর, মহি মুহাম্মদের উপন্যাস ময়নাদ্বীপ প্রকাশ করেছে ইত্যাদি প্রকাশন।