কেন ৬ বছর ধরে একই স্কুলব্যাগ ব্যবহার করে জাপানি শিশুরা
ষষ্ঠ বছরটা জাপানের একটা শিশুর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় একটা শিশু পরিবারের বাইরে স্কুল নামের প্রতিষ্ঠানে যায়। অবশ্য কিছু কিছু শিশু আগেই প্রাক্বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়। বিশেষ করে যাদের মা–বাবা উভয়েই কর্মজীবী। সাধারণত ১ এপ্রিল প্রথম স্কুলের আঙিনায় পা রাখে শিশুরা। তবে ডিসেম্বর মাস থেকেই শুরু হয় তোড়জোড়। আর এ জন্য জাপানের বিভিন্ন শপিং মল আর বাজারগুলো নতুন পণ্যের সংগ্রহ নিয়ে সেজে ওঠে। এসব পণ্যের মধ্যে অন্যতম হলো স্কুলব্যাগ—‘রান্ডোসেরু’।
শিশুদের প্রথম ব্যাগ—রান্ডোসেরু
রান্ডোসেরু উন্নত উপকরণে তৈরি বক্স আকৃতির ব্যাকপ্যাক। ঐতিহ্যগতভাবে চামড়া থেকে তৈরি টেকসই এই ব্যাগগুলো দৈনন্দিন নানা কাজে ব্যবহারেরও উপযোগী। সাধারণত মেয়েশিশুরা লাল বা গোলাপী আর ছেলেরা কালো রঙের ব্যাগ ব্যবহার করে। তবে বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই। অনেকে প্রথা ভেঙে অন্য রঙের ব্যাগও তুলে নেয়।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো শিশুজীবনে একজন একবারই সাধারণত রান্ডোসেরু পায়। যেটা তাকে প্রথম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়। যে ব্যাগ প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার কাছে মনে হয় বিশাল, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর সেটিই তার কাছে মনে হয় যথেষ্ট ছোট।
সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর শিক্ষার্থীরা নতুন ব্যাগ ব্যবহার করা শুরু করে। রান্ডোসেরুকে রেখে দেয় স্মৃতি ও স্মারক হিসেবে। সম্প্রতি কিছু ব্যাগ আপসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। স্কুল থেকে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার সময়ই এই ব্যাগগুলো আপসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহারের জন্য বিক্রি করে দেওয়া হয়।
নিছক ব্যাগ নয় রান্ডোসেরু
একটি শিশু কতটুকু যত্নবান, তা তার রান্ডোসেরু দেখেই বোঝা যায়। রান্ডোসেরু নিছক শিক্ষা উপকরণ নয়, বরং শিক্ষা, দায়িত্ব, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধের প্রতীক। এই ব্যাগের ভেতর দিয়ে একটা শিশু প্রথম দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা নিজেদের সম্পদের যত্ন নিতে ও রক্ষা করতে শেখে। ঠিক এ কারণেই ছয় বছর ব্যাগটি ব্যবহারের পরও অনেকের ব্যাগ থাকে নতুনের মতো। যে মুহূর্ত থেকে একটি শিশু তার প্রথম রান্ডোসেরু পায়, তার শিক্ষাগত যাত্রার এই প্রতীকটির যত্ন নেওয়ার দায়িত্বও তার ওপর অর্পিত হয়, যা অনেকটা ‘হোমওয়ার্ক’ বা বাড়ির কাজের মতো। রান্ডোসেরু একজন জাপানিজ শিক্ষার্থীর প্রাথমিক বিদ্যালয়জীবনের সবচেয়ে দামি ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
জাপানি বিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত বেশির ভাগ শিক্ষা উপকরণ স্কুল থেকেই দেওয়া হয়। সেগুলো শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভেতরে ভাগাভাগি করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে একেবারে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের ভেতরে সমতা ও বণ্টনের শিক্ষা গড়ে ওঠে।
জাপানি শিক্ষার্থীদের অল্প বয়স থেকেই তাদের জিনিসপত্রের যত্ন নিতে শেখানো হয়। রান্ডোসেরু এই যত্ন নেওয়ার শিক্ষার একটা অংশ। জাপানি স্কুলগুলোতে কেবল প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, বরং জীবনে চলার পথে প্রয়োজনীয় নানা কিছু শেখানো হয়।
কেমন দাম?
রান্ডোসেরুর দাম ব্র্যান্ড ও মানের ওপর নির্ভর করে। তবে সাধারণভাবে এই ব্যাগের দাম ২০ হাজার ইয়েন বা ১৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২ লাখ ইয়েন বা ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা হয়। তবে কেউ চাইলে এর বেশি দামের ব্যাগও কিনতে পারে। ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ কিছু ব্যাগ ২০ হাজার ইয়েনের কমেও পাওয়া যায়।
দামের বিস্তর ফারাক হলেও ব্যাগগুলো দেখতে মোটামুটি একই রকম, পার্থক্য খুব একটা চোখে ধরার মতো নয়। দামের দিকে তাকালে মনে হতেই পারে যে রান্ডোসেরু অনেক দামি। তবে এই ব্যাপারে যদি অভিভাবকদের জিজ্ঞাসা করা যায়, তাহলে তাঁরা বলেন, এটা অনেক দামি। কারণ, এটা মূল্যবান।
জাপানি প্রথা অনুসারে শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই তাদের দাদা-দাদি বা নানি-নানি উপহার হিসেবে দেয় এই ব্যাগ। তবে এখন একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মা–বাবা কিনে দেন। আবার আমাদের দেশের মতোই কিছু কিছু পরিবারে অগ্রজ ভাই–বোনদের ব্যাগটাই অনুজেরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে যায়।
ড. মো. আবু বকর সিদ্দিক, গবেষক ও শিক্ষক, একীভূত শিক্ষা, প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা, টোকিও, জাপান