আমি তার সঙ্গে আর সংসার করতে চাই না
পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।
প্রশ্ন: আমার স্ত্রী সাত মাস আগে তার মায়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে আমাদের চার বছর বয়সী ছেলেকে। বাবার বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। আমি বলেছি, আমি ডিভোর্স দেব না, প্রয়োজন হলে সে ডিভোর্স দিতে পারে। এখন সেও ডিভোর্স দিচ্ছে না। আমার ছেলেকে আমার সঙ্গে দেখা করতেও দিচ্ছে না। মেয়ের পরিবারের কেউ আমাদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করতেও চাইছে না। একেবারেই নিশ্চুপ তারা। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সমঝোতা করার পদক্ষেপ আমি কয়েকবার নিয়েছি, কিন্তু উল্টো আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। আমি তার সঙ্গে আর সংসার করতে চাইছি না, কিন্তু আমার ছেলের দাবি আমি ছাড়তে পারব না। এই অবস্থায় আমার কী করণীয়, জানতে চাই। আর এই পরিস্থিতিতে আমাকে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে দিতে না চাইলে কী প্রতিকার আমি পেতে পারি?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। যেহেতু আপনার স্ত্রী আপনাকে ডিভোর্সের জন্য চাপ দিচ্ছেন এবং আপনিও এই বিয়ে টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছেন না, সে ক্ষেত্রে দুই পক্ষকে একটি সমাধানে আসতে হবে।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে যে তালাক দিতে চাইলে তাকে যেকোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর, অন্য পক্ষ যে এলাকায় বসবাস করছেন, সে এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌরসভার মেয়র বা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে। সেই সঙ্গে তালাক গ্রহীতাকে ওই নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, তালাকের নোটিশটি কত সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। আইনে বলা আছে, তখনই বা পরবর্তী সময়ে বা যথাশিগগির সম্ভব। নোটিশ পাঠানোর কাজটি ডাকযোগে, আবার সরাসরিও হতে পারে। ডাকযোগে রেজিস্ট্রি করে এডি (অ্যাকনলেজমেন্ট ডিউ) সহযোগে পাঠালে ভালো।
চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে যে তারিখে নোটিশ পৌঁছাবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন পর বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক কার্যকর হবে। এ নোটিশ পাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে সালিসি পরিষদ গঠন করতে হবে এবং সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিসের কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে।
একটি বিষয় পরিষ্কার না, আপনি যদি স্ত্রীর সঙ্গে আর সংসার করতে না চান, তাহলে ডিভোর্স কেন দিতে চাইছেন না? অনেক সময় পুরুষেরা মনে করেন, স্ত্রী তালাকের নোটিশ পাঠালে তাঁর দেনমোহর পরিশোধ করা লাগবে না। আপনিও যদি এই ভাবনা থেকে নিজে তালাক দিতে না চান, তাহলে জেনে রাখুন, তালাক যে পক্ষ থেকেই দেওয়া হোক না কেন, স্ত্রীকে দেনমোহরের টাকা শোধ করতেই হবে।
আর অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সী সন্তানকে নাবালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর ওই সন্তানের অভিভাবক হলেন তিনি, যিনি ওই সন্তানের শরীর কিংবা সম্পত্তি অথবা উভয়ের তত্ত্বাবধান ও ভরণপোষণে আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। পারিবারিক আইনের আওতায় প্রায় সব ধর্মের আইনেই বাবা সন্তানের প্রকৃত আইনগত অভিভাবক। সাধারণত সব ধর্মেই মা-বাবার বিচ্ছেদ বা যেকোনো একজনের মৃত্যুর পরই অভিভাবকত্বের প্রশ্নটি আসে। মুসলিম পারিবারিক আইনে সন্তানের তিন ধরনের অভিভাবকত্বের কথা বলা আছে। সেগুলো হলো সন্তানের অভিভাবকত্ব, সন্তানের সম্পত্তির অভিভাবকত্ব, সন্তানের বিয়ের অভিভাবকত্ব।
নাবালকের সার্বিক মঙ্গল ও কল্যাণের গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইন অনুযায়ী সন্তানের মাকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তানের জিম্মাদারিত্বের অধিকার দেওয়া হয়েছে, তবে মা কখনো সন্তানের অভিভাবক হতে পারেন না। এই জিম্মাদারির সময়কাল হলো ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে সাত বছর, মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে বয়োসন্ধিকাল পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে ছেলেশিশুকে সাত বছর পর্যন্ত মা তাঁর জিম্মায় রাখতে পারেন। সন্তানের জিম্মাদারিত্বের নির্দিষ্ট বয়স পার হলেই যে সন্তান বাবার জিম্মায় যাবে তা নয়, সাত বছর অতিক্রম করার পরও ছেলে সন্তানের সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করে সন্তানের হেফাজত আবার মায়ের কাছে ন্যস্ত হতে পারে।
নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্য সব ব্যাপারে নৈতিক ও অর্থনৈতিক সব সুবিধা প্রদান করা একজন অভিভাবকের দায়িত্ব। প্রচলিত একটি ধারণা রয়েছে যে মা আবার বিয়ে করলে নাবালক সন্তানের জিম্মার অধিকার হারান। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে আদালত অবস্থা বিবেচনা করে নাবালককে পুনর্বিবাহ সত্ত্বেও মায়ের জিম্মায় রাখার আদেশ দিতে পারেন।
যেহেতু আপনার পুত্রসন্তান এবং তার বয়স চার বছর। আইন অনুযায়ী তাই সে মায়ের হেফাজতেই থাকবে। আপনি স্ত্রীর সঙ্গে আপস মীমাংসার মাধ্যমে এবং পরিবারের অন্যদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সন্তানকে নিজের কাছে আনতে পারেন। তবে সে রাজি না হলে, পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পারিবারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজের আদালতে আপিল করা যায়। আদালতের মাধ্যমে শিশুটির বিষয়ে কোনো আদেশ প্রদান করা হয়ে থাকলে যদি কেউ আদালতের এখতিয়ারের সীমা থেকে তাঁকে সরিয়ে নেয়, তাহলে আদালতের আদেশে ওই ব্যক্তি অনূর্ধ্ব এক হাজার টাকার জরিমানা অথবা ছয় মাস পর্যন্ত দেওয়ানি কারাবাস ভোগ করতে বাধ্য থাকবেন।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা