আচার সমাচার
ক্লিওপেট্রার খ্যাতি আজও ছড়িয়ে আছে তাঁর চোখধাঁধানো রূপের জন্য। দুনিয়ার তাবড় তাবড় সেনাপতি, সম্রাটরা সেই রূপের নাগাল পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। অবশেষে সম্রাট অগাস্টাস সিজারের ঘনিষ্ঠ সহচর মার্ক অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রার প্রেমে সফল হয়ে সম্রাটকেই ভুলে গেলেন বেমালুম। অগাস্টাস সিজার এই প্রেমের জন্য কাকে দায়ী করেছিলেন—ধনবতী রানি ক্লিওপেট্রাকে, নাকি রূপবতী ক্লিওপেট্রাকে? এ বিষয়ে ইতিহাস নীরব থেকেছে বরাবর। কিন্তু আচারের ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা নীরব থাকেননি। বরং জানিয়েছেন, ক্লিওপেট্রা তাঁর রূপের জন্য আচারকেই ‘দায়ী’ করেছিলেন। বিভিন্ন স্বাদের আচার খেতে পছন্দ করতেন তিনি। ক্লিওপেট্রার ধারণা জন্মেছিল, তাঁর ভুবনমোহিনী রূপের গোপন রহস্য ছিল সেসব আচার।
গবেষকদের বয়ান করা ইতিহাস এটাও সাক্ষ্য দেয়, প্রতিশোধস্পৃহায় কাঁপতে থাকা অগাস্টাসের পালক পিতা জুলিয়াস সিজার তাঁর সৈন্যদের শক্তিশালী বানাতে নিয়মিত আচার খাওয়াতেন। তবে অ্যান্টনিও আর ক্লিওপেট্রার যৌথ বাহিনীকে ঘোল খাওয়ানো অগাস্টাস বাবার নিয়ম মেনে তাঁর সৈন্যদেরও নিয়মিত আচার খাওয়াতেন কি না, সে বিষয়ে ইতিহাস পুনরায় নীরব।
সে যা–ই হোক, ইতিহাসের কথা যখন উঠলই তখন জানিয়ে রাখা যাক, মূলত ফলমূল, সবজিসহ বিভিন্ন খাবার দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য আচার নামের খাবারটির জন্ম হয় পৃথিবীতে। ধারণা করা হয়, ভারতীয় উপমহাদেশেই তৈরি করা হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম আচার। আবার এটাও বলা হয়ে থাকে, ২৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ান সভ্যতার সময় থেকে মানুষ আচার খাওয়া শুরু করে। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিভিন্ন পদ্ধতিতে তৈরি করা আচারের ইতিহাস মোটামুটি চার হাজার বছরের প্রাচীন। তাহলে প্রাচীনতম আচার বানানো হয়েছিল কী দিয়ে? পৃথিবীর প্রাচীনতম আচারের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় শসার তৈরি আচারের কথা।
ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ২০৩০ সালে মেসোপোটেমিয়ানরা শসার আচার তৈরি করেছিল তাদের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতেই। শুধু শসা নয়, গাজর, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, বেগুন, টমেটো, বরবটি ইত্যাদি দৃশ্যমান প্রায় সব ধরনের সবজি দিয়েই আচার তৈরি করা যায়। আমাদের দেশও তার বাইরে নয়।
আচার ছাড়া ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করতে পারতেন না বলে কথিত আছে। ১৪৯২ সালের আমেরিকা অভিযানে কলম্বাস তাঁর নাবিকদের রেশন হিসেবে আচার দিতেন। এই আচার তাঁদের ভিটামিন সির অভাব মিটিয়ে স্কার্ভি রোগের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। গবেষকদের ধারণা, সেসব আচারের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আচার ছিল সবজির তৈরি। যে ঋতুতে যে সবজি পাওয়া যায় পাকা রাঁধুনিরা দীর্ঘদিন সেসব সবজি খাওয়ার জন্য আচার বানিয়ে রাখেন। শীতকাল আমাদের দেশে সবজির আচার তৈরি করার আদর্শ সময়। এই এক ঋতুতে আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের সবজি পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে।
১৯৫২ সালে কলকাতায় প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ভাষায় লেখা স্নেহলতা দেবীর আচার ও মোরব্বা নামের অসাধারণ এক বই। সে বইয়ে তিনি লিখেছিলেন ওল, ওলকপি, ফুলকপি, করলা, মুলা, মানকচু ইত্যাদি সবজির আচারের কথা। সেখান থেকেই আপনাদের জন্য দুটি আচারের রেসিপি বাতলে দিই।
প্রথমে মানকচুর আচার। মানকচু আধা ইঞ্চি পুরু করে চাকা চাকা করে কেটে নিয়ে ছাল ছাড়িয়ে নিন। তারপর সেই চাকাগুলো চার টুকরা করে নিন। পানি ফুটিয়ে তাতে মানকচুর টুকরাগুলো দিয়ে দুই মিনিট ঢেকে রাখুন। তারপর নামিয়ে ২–৩ ঘণ্টার জন্য রোদে শুকাতে দিন। শুকানো হয়ে গেলে মানকচুগুলোতে লবণ, হলুদ, মরিচের গুঁড়া, রাই শর্ষেবাটা মাখিয়ে কাচের বয়ামে রেখে বয়ামটি শর্ষের তেলে ভর্তি করে দিন।
এবার ফুলকপির আচার। পরিপক্ব একটি ফুলকপি নিন। তরকারি রান্নার জন্য যেভাবে ফুলগুলো কাটেন, বোঁটাসহ সেভাবে ফুলকপি কেটে রাখুন। পানি গরম করে তাতে ফুলগুলো দিয়ে ঢেকে রাখুন ৩–৪ মিনিট। কপি সেদ্ধ করে গলিয়ে ফেলা যাবে না। এবার নামিয়ে পানি ঝরিয়ে রোদে দিন। শুকাতে থাকুক। ততক্ষণ আপনি হিং ভেজে গুঁড়া করে নিন। সঙ্গে মেথি, জিরা, কালিজিরা, মৌরি ভেজে গুঁড়া করে নিন। তারপর কপির ফুলে লবণ, মরিচগুঁড়া, হলুদ এবং ভাজা মসলাগুলো দিয়ে ভালো করে মেখে নিয়ে একটি কাচের বয়ামে রেখে দিন। তারপর ওপর থেকে শর্ষের তেল ঢেলে ফুলকপির ফুলগুলো ডুবিয়ে রেখে বয়ামের মুখ বন্ধ করে দিন। যত বেশি দিন রাখবেন, ফুলকপির এই আচার ততই সুস্বাদু হবে।
তবে সবজির আচার তৈরির সবচেয়ে জটিল বিষয় হলো মসলার ব্যবহার। খাবারে মসলার ব্যবহার একটা খেলার মতো বিষয়। কোন সবজির সঙ্গে কোন মসলা ব্যবহার করা যায়, তার পূর্ব–অভিজ্ঞতা না থাকলে শুধু আচারই নয়, কোনো খাবারই সুস্বাদু করা যায় না বলেই আমার বিশ্বাস। মসলার পার্থক্য অনুসারে দুটি সহজ আচারের রেসিপি বলে দিই এখানে।
মটরশুঁটির আচার। মটরশুঁটি ধুয়ে পরিষ্কার করে পানি ঝরিয়ে নিন। কোনোভাবেই যেন এতে পানি না থাকে। এ জন্য সেগুলোকে হালকা করে রোদে শুকিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এই শুকনা মটরশুঁটি সিরকার মধ্যে ডুবিয়ে দিলেই তৈরি হবে এই আচার। স্বাদ বাড়ানোর জন্য অল্প পরিমাণ লবণ দিন, একটু চড়া হলেও খেতে ভালো লাগবে। এর সঙ্গে বোঁটা ফেলে আস্ত কাঁচা মরিচ দেওয়া যায়। তাতে আচারে পাবেন ঝালের স্বাদ। সপ্তাহখানেক রাখলেই মটরশুঁটির এ আচার খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে যাবে।
এবার বলি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সাতকরার আচার বানানোর কথা। সাতকরা ছোট ছোট কিউব করে কেটে হলুদ মাখিয়ে এক দিন রোদে শুকিয়ে নিন। বেশি করে শর্ষের তেল নিন কড়াই বা ফ্রাইপ্যানে। তেলে পাঁচফোড়ন, হলুদ এবং জিরা, মৌরি ইত্যাদি মসলা দিয়ে হালকা করে কষিয়ে নিন কিউব করে কাটা সাতকরা। তুলে ঠান্ডা করে তেলসহ বয়ামে রেখে দিন। বলে রাখি, এই আচার সারা বছর বিভিন্ন তরকারির সঙ্গে মিশিয়ে রান্না করে খেতে হবে।
সবজির আচারের বৈচিত্র্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সবজির আচার তৈরি করা হয়। যেখানেই যান, একটু চেখে দেখার চেষ্টা করবেন। হাজার হলেও আচার কিন্তু ক্লিওপেট্রার পছন্দের খাবার ছিল।