আশপাশে ইফতারির এমন বাজার আর কোথায় আছে?
‘আশপাশে কী বলেন, ঢাকা শহরেই নাই। পুরা ওয়ার্ল্ডেই এমন মার্কেট পাবেন না।’ ব্যবসায়ী মো. আফজালের কথা এটা। রাজধানীর চকবাজারে রাস্তাজুড়ে রমজান মাসে যে ইফতারির বাজার বসে সেটা নিয়েই গর্ব করে তিনি এই কথা বলেন। আফজাল নিজেও বসেছেন ইফতারির পসরা নিয়ে।
কত দিনের পুরোনো এই বাজার?
তথ্য দেন মো. আফজাল, ‘দেড় শ বছর তো হবেই। সেই মোগল আমল থেকে রোজার মাসে বসছে এই বাজার।’
বছরের বাকি সময়?
রিকশার জট আর দুই পাশের দোকানগুলোর মালামাল থাকে। জানান একজন খেলনা বিক্রেতা।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশের রাস্তার দক্ষিণ দিকের এই জায়গাটা আসলে প্রশস্ত এক সড়ক। এটি পেরিয়ে আরেক গলি চলে গেছে বুড়িগঙ্গায়।
প্রতিবছর রমজান মাস এলে চকের এই ইফতারি বাজারের কথা চলে আসে গণমাধ্যমসহ সবকিছুতেই। ২৬ জুন সারা দিনই ঢাকায় বৃষ্টি। বিকেলে যখন আমরা চকবাজারে, তখনো বৃষ্টি। কখনো বেশি, কখনো ঝিরিঝিরি। ইফতারির বাজার কিন্তু ঠিকই জমজমাট। খোলা চত্বরে প্রতিটি অস্থায়ী দোকানের ওপর পলিথিনের ছাউনি। কিছুক্ষণ পরপর সে পলিথিনের একেক কোনা টেনে জমে থাকা পানি ফেলা হচ্ছে। এসবের মধ্যেই দেখা গেল সংবাদ সংস্থা বিবিসির ক্যামেরা। চলমান ও স্থির—দুই ধরনের ছবি-ই ধারণের জন্য বিবিসি কর্মীর কাঁধ আর হাতে দুটি ক্যামেরা। কাছে গিয়ে দেখা গেল তিনি গরম তেলে বেগুনি ভাজার ছবি তুলছেন।
এই বাজারে মোটামুটি ইফতারির সব পদই তৈরি আর বিক্রি একসঙ্গেই চলে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের সব পদ নিয়ে বসে ইফতারির এই বাজার।
ইফতারির জন্য চকবাজারের যেমন নামডাক, তেমনি এই বাজারের যে পদটি পেয়েছে ‘তারকাখ্যাতি’ সেটার নাম ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। বোঝাই যাচ্ছে শৌখিন মানুষের খাবার এটি। জিনিসটি আসলে কী? পাঁচমিশালি খাবার। তবে পাঁচ পদের মিশেল নয়। শেখচূড়া দোকান থেকে জানা গেল ৩২টি পদ থাকে এটাতে। ১০-১২ রকমের মসলা। চিড়া, মুড়ি, কাবাব যেমন থাকে তেমনি গরু-খাসি-মুরগি-হাঁস-কোয়েল-কবুতরের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে মেশানো হয়। থাকে তেল, ঘি আর ভাজা মসলাসহ নানা কিছু। আবার হাজি নূর হোসেন বাবুর্চির দোকানে এটাই তৈরি হয় ২৪ পদ দিয়ে। সবকিছু একসঙ্গে মিশিয়ে তারপর বিক্রি হয় ৩৫০ টাকা কেজি দরে। সবকিছুর মিশেল থাকে বলে এটা কিনে নিয়ে বেশিক্ষণ রেখে দিয়ে খেলে পুরো স্বাদটা পাওয়া যাবে না। কেনার পর যত তাড়াতাড়ি খাওয়া যায় ততই ভালো। এই হলো বড় বাপের পোলায় খায় নামের বড় মাপের খাবার। নামের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে আছে আরও এক লাইন ‘ঠোঙায় ভইরা নিয়া যায়’।
ঐতিহ্যের যেসব খাবার আছে চকের এই ইফতারি বাজারে, সেসবের মধ্যে বিশাল এক বৈশিষ্ট্যও কাজ করে। যেমন এখানে সাধারণ জিলাপির পাশাপাশি পাওয়া যায় শাহি জিলাপি। প্যাঁচে প্যাঁচে তৈরি একেকটা জিলাপির ব্যাস কমসে কম ৭-৮ ইঞ্চি। আর ওজন এক, দেড়, দুই কিংবা আড়াই কেজি। সেই জিলাপি কড়াইতে ভাজা হচ্ছে, আর বিক্রি হচ্ছে গরম-গরম।
রোস্টের কথা বলা যাক এবার। মুরগি, কবুতর কিংবা খাসির পায়ের রোস্ট পর্যন্ত তো ভাবাই যায়, কিন্তু এখানে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হাঁস আর কোয়েল পাখির রোস্টও। আর আছে ঐতিহ্যবাহী সুতি কাবাব। গরু আর খাসির কাবাব দিয়ে বানানো শাশলিকও চোখে পড়ল এবার।
বাঙালির ইফতারির অনিবার্য খাবার ছোলা ভুনা—সেটাও আছে। তবে এর তেল আর মরিচের মসলা দেখে খাওয়ার জন্য সত্যিই বুকের পাটা লাগবে। ঘুগনিও মাখিয়ে দেওয়া হয় বিশেষ মসলা দিয়ে। বেগুনি, পেঁয়াজু, মাষকলাই ডালের বড়া—এমন পদের দেখা তো মিলবেই। এক পাশে সাজানো আছে ফলমূলের পসরা। শসা, ধনেপাতা, লেবু, ভেজানো কাঁচা ছোলাও আছে চকের এই ইফতারি বাজারে। এখানকার হালিমও অন্যরকম। গরুর বড় বড় হাড়ের হালিম। শরবতেরও আছে রকমফের—গুড়ের শরবত, লেবুর শরবত, ইসবগুলের ভুসির শরবত আর বেলের শরবত। এবার বলতে হয় মাঠার কথা। মাঠার সঙ্গে যোগ হয়েছে অধুনা প্রচলিত লাবাং নামের পানীয়ও। তবে মাঠার কাটতিই বেশি দেখা গেল।
চকের ইফতারি বাজারে এবারে অনলাইনের ছোঁয়াও পাওয়া গেল। ছোট্ট একটা কার্ট নিয়ে বসেছে ‘ঢাকা টুইস্ট’ নামের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক-ভিত্তিক দোকান। আরও চোখে পড়ল দোকানিদের সচেতনতা। বেশির ভাগ বাবুর্চি ও দোকানি হাতে পলিথিনের গ্লাভস আর মাথায় পরে আছেন পলিথিনের টুপি। এখানে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, সবকিছুই গরম-গরম। তৈরি হচ্ছে আর
বিক্রি হচ্ছে।
বৃষ্টির মধ্যেও দেখা গেল বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর থেকে লোকে লোকারণ্য। ক্রেতাদের ভিড়ে হাঁটাই যেন দায়। দোকানির হাঁকডাক আরও গেছে বেড়ে—বড় বাপের পোলায় খায়...।