পাণ্ডু রোগের দিনগুলোতে
২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের কথা। হালকা একটা জ্বরজ্বর ভাব ছিল সপ্তাহখানেক ধরে। দুই সপ্তাহ আগেও এমন আরেকবার হয়েছিল। ভেবেছিলাম মৌসুমি জ্বর হবে। একদিন বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। অফিস থেকে যেদিন ছুটি নিলাম, সেদিনই জ্বর বাড়ল। সঙ্গে অস্থিরতাও।
মুখে কিছুই দেওয়া যাচ্ছিল না। একটু কিছু পেটে ঢুকেছে তো মিনিট পাঁচের মধ্যে ওয়াশরুমের বেসিনে সেসব ফেলে দিয়ে আসতে হতো। এমনই বমি, যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে পেটের সব নাড়িভুঁড়ি। সেদিন প্রায় কিছুই না খেয়ে কাটাতে হলো। ক্ষুধাও ছিল না। পরদিনই ছুটতে হলো হাসপাতালে। চিকিৎসক আমার চোখ পরীক্ষা করে বলে দিলেন, জন্ডিস। চোখের হালকা হলদেটে ভাবটা এর আগে কেউই আমরা লক্ষ করিনি।
এরপর কত যে পরীক্ষা! বিলিরুবিনের মাত্রা ৬। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এসজিপিটিসহ আরও কয়েকটি পরীক্ষাতেও কয়েক গুণ বেশি মাত্রার ফলাফল মিলল। চিন্তা ছিল হেপাটাইটিস বি বা সি হলো কি না। হেপাটাইটিস বি-এর টিকা দেওয়া ছিল। কিন্তু চিকিৎসক বললেন, না সেই চিন্তা নেই, এটা হেপাটাইটিস এ। কিন্তু হেপাটাইটিস এ-ই যে দীর্ঘ চার মাস ভোগাবে, তখন কে জানত। ধীরে ধীরে সারা শরীর ফ্যাকাশে হতে শুরু করল। এত হলদে ভাব যে মনে হচ্ছিল গায়ে হলুদ মেখে দিয়েছে কেউ। এই হলদে ফ্যাকাশে ভাবের জন্যই রোগটার আরেক নাম পাণ্ডু।
চিকিৎসকের কথামতো কেবল বিশ্রাম নেওয়া চলছে। বিশ্রাম মানে শুয়ে থাকা। এভাবেই নাকি বিলিরুবিন কমে যাবে। কিন্তু বিলিরুবিন কমার নাম নেই। ৬ থেকে ৮, তারপর ১২, ১৫—এভাবে দুই মাস পর পাওয়া গেল ২১! প্রায় প্রতি সপ্তাহে বিলিরুবিন, এসজিপিটিসহ কয়েকটি পরীক্ষা করা হতো। বোঝা গেল, বেশ ভুগেই নিস্তার পেতে হবে।
চিকিৎসক বলেছিলেন, বাড়ির সব খাবারই খাওয়া যাবে, তবে তৈলাক্ত বা খুব ভারী খাবার নয়। সেসব খাওয়ার ইচ্ছাও হয় না। মুখে যে কিছুই রোচে না। অনেক খাবার নাকের কাছে এলেই বমি আসে। মা পড়লেন মহা ঝামেলায়। একবেলার খাবার অন্য বেলায় দিলেও খেতে চাইতাম না। সবচেয়ে ভালো লাগে, না খেয়ে থাকতে পারলে। ডাব, শরবত, খাওয়ার স্যালাইন এগুলোই প্রধান খাবার তখন। ৪ মাসে ১৭ কেজি পর্যন্ত ওজন কমে গিয়েছিল।
সারা দিন শুয়ে থাকতে কতক্ষণ আর ভালো লাগে। কিন্তু কিছুক্ষণ বসে থাকলেও খারাপ লাগা শুরু করত। এত দীর্ঘকাল কোনো রোগে ভোগার অভিজ্ঞতা ছিল না আমার। এ সময় ঘুমানো ভালো, কিন্তু ঘুমের কোনো টাইমটেবিল ছিল না। ঘুমও ছিল পাতলা, সামান্য শব্দে ভেঙে যেত। মেজাজ হয়ে উঠত আরও খিটখিটে।
আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার এই যুগেও জন্ডিস নিয়ে মানুষের কুসংস্কারের শেষ নেই। জন্ডিস হলে তরকারিতে হলুদ দেওয়া যাবে না, তারপর আছে পানিপড়া, কবিরাজিসহ নানা রকম চিকিৎসা। এসব চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শও আসে। এগুলোতে কান দেওয়া যাবে না। স্বাভাবিক চিকিৎসাতেই রোগমুক্তি হবে, কখনো কখনো একটু বেশি সময় লাগবে। আমাদের চিকিৎসক বলেছিলেন, চিকিৎসার নামে এসব টোটকা ব্যাপারগুলো আমাদের এখানেই চলে খালি। এসব বিষ।
কর্মজীবনের ব্যস্ততায় ছুটির আশায় থাকে মানুষ। কিন্তু এই অসুখী ছুটি কেউ চায় না। সময়ই কাটতে চায় না যেন। বই পড়ায় মন দিতে পারছিলাম না তেমন। প্রচুর সিনেমা দেখা হয়েছে। ইউটিউবে তথ্যচিত্র। বন্ধুরা নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছে। কথা হয়েছে।
জন্ডিসে ভুগে নতুন করে বুঝেছিলাম, শেষমেশ জীবনে পরিবারের গুরুত্ব কতটা। সন্তানের কাছে মা-বাবা আসলে কতটা জরুরি। কিছুই যখন ভালো লাগত না, তখন মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, তখন মনে হতো আমি তো ভালোই আছি। বাবা তাঁর সব কাজ ফেলে অনেকটা সময় বাসায় ছিলেন এই চার মাস। সেই ছোটবেলার পর মা-বাবার এত কাছাকাছি কোনো দিন যাইনি। একই বাসায় থেকেও আমরা নিজেদের নানা অনুষঙ্গে ব্যস্ত থাকি। অযথা। অথচ আমাদের কিছু হলে তাঁরাই পাশে থাকেন, নিঃশর্তে-নিঃস্বার্থে। একমাত্র বোনের বিয়ের দিন ঠিক হয়ে ছিল এরই মধ্যে। জন্ডিসের যাতনায় সেখানেও ঠিকমতো থাকতে পারলাম না।
শেষের মাসে চলে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়ি। অনেক দিন পর কোলাহলহীন গ্রামীণ পরিবেশে শরীর-মন দুটোই আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠেছিল। তবে দুর্বলতা কাটতে সময় লেগেছে আরও অনেক দিন। সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দেওয়ার পর। আশে পাশে অনেককেই দেখি পানিবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হতে। জন্ডিসের দিনগুলোতে যন্ত্রণাও কম নয়, তবে ঘরে থেকে সঠিক চিকিৎসা আর বিশ্রাম নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা যায়।