বাড়িবন্দী সময়ে শিশুর পড়াশোনা

শিশুর শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে। ছবি: প্রথম আলো ফাইল ছবি
শিশুর শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে। ছবি: প্রথম আলো ফাইল ছবি

করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। নতুন সংক্রমণের সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে সরকার আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ রেখেছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন বাড়িবন্দী থাকতে থাকতে অনেকেই বাড়িকে স্কুল বানিয়ে ফেলেছে। অনেক মা-বাবা ভাবছেন, স্কুল তো বন্ধ, বাড়িই এখন স্কুল। দিনের এক-দুই ঘণ্টা শিশুদের স্কুল থেকে দেওয়া হোমওয়ার্কের জন্য বরাদ্দ থাকতে পারে। কিন্তু এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাড়ি কখনোই স্কুলের সম্প্রসারণ নয়। বাড়িও স্কুলের মতো শিশুর জন্য আরেকটি শিক্ষালয় বটে, তবে কাঠামো ও পরিবেশের দিক থেকে কোনোভাবেই স্কুলের মতো নয়। কাজেই শিশুদের জন্য এই সময় বাড়িকে বিশেষভাবে সাজাতে হবে।

এ সময় শিশুদের জন্য বাড়িতে যা করবেন

১. পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সহজ ও ভয়হীন করুন, মা-বাবার ব্যক্তিত্ব যেখানে শিশুর জন্য অনুকরণীয় হবে।
২. সার্বক্ষণিক আনন্দময় পরিবেশ বজায় রাখুন। পরিবারের নিজস্ব নিয়মনীতিগুলো সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হতে হবে।
৩. ছোট-বড়নির্বিশেষে পরিবারের সবার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার পারিবারিক সংস্কৃতি নিশ্চিত করুন। পরিবারে কেউ কারও অধীনে নয়—এমন মনোভাব তৈরি করুন।
৪. বিতর্ক করার পরিবেশ তৈরি করুন। এমনকি ছোট শিশুও যেন দ্বিমত পোষণ করতে পারে তার অপছন্দের ব্যাপারে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে বাড়িতে।
৫. শিশুদের দিয়ে কিছু করিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে লোভ বা ভয় না দেখিয়ে নিঃশর্ত ভালোবাসার মাধ্যমে শিশুকে দিয়ে করিয়ে নিন কাজটি।
৬. শিশুকে কঠোর শাসনে রাখা এবং অতিরিক্ত স্বাধীনতা দেওয়ার মধ্যে নিরন্তর সমন্বয় সাধন করুন। মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ হচ্ছে, এই সমন্বয় সম্ভব না হলে কঠোর শাসনের চেয়ে প্রশ্রয় ভালো পদ্ধতি।
৭. শিশুর অকপট ও নির্ভয়ে কথা বলার পরিবেশ তৈরি করুন। এর সঙ্গে শিশুর নিজস্ব জগৎ তৈরিতে তাকে সহায়তা করুন।
৮. নিজেরা মানেন না এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করবেন না। বড় শিশুদের ১৮ বছর বয়সের আইনানুগ অধিকারের কথা বোঝান।

এ বিষয়গুলো ঠিক করতে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলুন এবং তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। শিশুর সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ:

• শিশুর সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। শিশুটিও তাহলে সব কথা শোনায় অভ্যস্ত হবে। শিশুর প্রতিটি কথাকে যদি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সে সহজেই মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনবে এবং আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে।
• শিশুকে কী কী করা অনুচিত, সেটা না বলে কী কী করা উচিত সেটা বলুন।
• শিশু ভালো কিছু করলে বিস্তারিত ও যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যাসহ প্রশংসা করুন, ভিত্তিহীন প্রশংসা করবেন না।
• শিশুর প্রশংসা করতে হবে শিশুর ব্যক্তিত্ব, সুস্থ বিতর্ক, বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন, দায়িত্বশীল আচরণ ইত্যাদি সূত্রে।
• যেকোনো ইতিবাচক প্রয়াসের জন্য শিশুকে প্রশংসা করুন, সফলতার জন্য নয়।
• শিশুকে তার আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করতে উৎসাহিত করুন।
• মা-বাবার কথা বলার স্টাইলই শিশুর কাছে বিবেচ্য হবে, শিশুটি কীভাবে কথোপকথনে যুক্ত হচ্ছে, সেটা জরুরি নয়। কাজেই নিজেদের কথা বলার ধরনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনুন।
• মা-বাবার যদি কখনো মনে হয় সঠিক কথাটি মনে আসছে না, তাহলে একটু থেমে থাকা ভালো। শিশুকে কঠিন কিছু বলার চেয়ে কিছু না বলাই শ্রেয়।
• আপনার আলোচনা যে জরুরি, শিশুটিকে সেটা বোঝাতে হবে। বিষয়টি মা-বাবার অন্য সব কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কথা বলার সময় হাতের কাছে ফোন বা ল্যাপটপ রাখবেন না। তাতে শিশু মনে করতে পারে, আপনি তার সঙ্গে অযথাই আলোচনা করছেন।

শিশুর যেকোনো অপ্রত্যাশিত আচরণে করণীয়

• কোনো কিছু বলা বা করার আগে শিশুর অনভিপ্রেত আচরণের পেছনের কারণ জানা এবং শিশুর অবস্থান থেকে বোঝার চেষ্টা করুন।
• শিশুকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা না ভেবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবুন।
• অভিভাবক হিসেবে শিশুর প্রতি চাহিদা বা প্রত্যাশায় নিয়ন্ত্রণ রাখুন। বয়স অনুসারে অধিকার ও দায়বদ্ধতার একটি মানদণ্ড তৈরি করে তা বজায় রাখুন, একেক সময় একেক রকম নয়।
• শিশুকে দিয়ে কোনো কিছু করিয়ে নেওয়ার জন্য উপহার বা অন্য কোনো প্রলোভন দেখাবেন না কিংবা ভয় দেখাবেন না।
• শিশুর প্রত্যাশিত আচরণের দিকে মনোযোগ রেখে তার অপ্রত্যাশিত আচরণকে অবজ্ঞা করুন।

যেসব শিশু ছবি আঁকতে পছন্দ করে, ধরে নেওয়া যেতে পারে এই সময়ে তাদের ব্যস্ত রাখতে অভিভাবকদের বেশি ভাবতে হচ্ছে না। তবে শিশুকে অনুপ্রাণিত করে এই আঁকার কাজকে একেকটি প্রকল্পের রূপ দিন। প্রতিদিনের একটি করে ভালো ছবি ক্যাপশনসহ জমা করুন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই সংগ্রহ দিয়ে একটি বই বাঁধাই করার চেষ্টা করতে পারেন।

এ সময়ে সময় কাটানোর একটি ভালো উপায় পরিবারের সবাই মিলে সিনেমা দেখা। শিশুদের বয়স অনুপাতে দেখার উপযোগী পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং ডকুমেন্টারি বিনোদনের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখে। এ জন্য বাড়ির সবাই বসে দেখার মতো বিষয় খুঁজে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইরানের চলচ্চিত্র কিংবা জাপানের অ্যানিমেশনের কথা বলা যায়। যারা শিশুদের সঙ্গে একটু সিরিয়াস ধরনের কিছু দেখতে চান, তাঁরা বিবিসি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ইউটিউব চ্যানেল ঘেঁটে দেখতে পারেন।

রান্নাঘর যে একটি সমৃদ্ধ বিজ্ঞানাগার, সে কথা আমরা অনেকেই খেয়াল রাখি না। সেটা কেবল পুষ্টিবিজ্ঞানের জন্য নয়। রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার অনেক কার্যকারণ রান্নাঘরে দেখানো যায়। গণিত ও সমাজবিজ্ঞানের জন্যও রান্নাঘর একটি ভালো ল্যাব হতে পারে। খুব ছোট শিশুদের রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর শিশুদের জন্য লেখা একটি বিজ্ঞানের বইয়ের নাম ‘আমরা যা খাই, আসলে ছাই খাই’। রান্নাঘরে বসে এই বইয়ের নাম বলুন শিশুরা অবাক হবে, আগ্রহও বাড়বে।

ভালো রান্নার জন্য পরিমাণের সূক্ষ্মতম হিসাব এবং সময়জ্ঞানের পর্যবেক্ষণ শিশুদের মনে গাণিতিক বোধ জাগাতে সহায়ক হবে। শিশুর প্রিয় খাবারের উপাদান নিয়ে খাবার টেবিলে তার সঙ্গে আলোচনা করুন। খাবারের সঙ্গে কত ধরনের মানুষ জড়িত, সেসব গল্প বলুন। দেখবেন, শিশু মজা পাচ্ছে। বিভিন্ন খাবারের উৎস নিয়েও কথা বলতে পারেন শিশুদের সঙ্গে।

বুদ্ধিমান মানুষ এখনকার ভাবনা ভাবতে ভাবতেই ভবিষ্যতের কথা ভাবেন। যাঁরা আরও বেশি ভাবতে পারেন, তাঁরা যদি নিজ নিজ শিশুদের অন্যভাবে ভাবতে সাহায্য করেন, সেটা খুব ভালো হয়। কারণ, এই শিশুরা এমন একটা সময় পার করছে, যা আমরা কেউ জীবনে দেখিনি। এখনই ওদের ভাবতে সাহায্য করলে ওরা যখন আমাদের জায়গা নেবে, ওদের কল্পনার ছবি আঁকার ক্যানভাস প্রশস্ততর হতে পারে। চলমান মহামারির সংখ্যা-পরিসংখ্যানের খবর শিশু-কিশোরদের না শুনিয়ে সুনামি অব ইনফরমেশন বা ইনফোডেমিক থেকে তাদের রক্ষা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: শিক্ষাকর্মী, সহজপাঠ উচ্চবিদ্যালয়