হুট করে খেলেন আর টুক করে সেরে গেল!
রবীন্দ্রনাথ সকালবেলা কী খেতেন? চা বা কফি আর নাশতা। আর? এক গ্লাস নিমপাতার রস, প্রতিদিন। ভাবার কোনো কারণ নেই যে নিমপাতার সেই সবুজ রসের স্বাদ স্বর্গীয় ছিল। কেন খেতেন? নিমপাতার ভেষজ গুণাগুণ যাতে শরীরকে উদ্দীপ্ত করে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোসহ আরও অন্যান্য উপকার করে, সে জন্য। তিনি কিন্তু হুট করে এক–আধ দিন টুক করে এক গ্লাস নিমপাতার রস খেয়ে বলেননি যে শরীরে ব্যাপক শক্তি পেলুম। আর সেই শক্তি দিয়ে শরীরের ভেতরকার রোগজীবাণুকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলুম। করোনাকালে 'ভাইরাল' ভাইয়ের হাত ধরে ভাইরাস মারার জন্য আমরা সে রকমই বলছি এখন।
এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে বলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য হুট করে এটা–সেটা খেলেন আর টুক করে আপনার শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেড়ে গেল, করোনা সংক্রমণ সেরে গেল। ব্যাপারটা অত সরল নয়।
বেশ কিছুদিন থেকে নেট দুনিয়ায় দেখা যাচ্ছে, করোনা থেকে রক্ষা পেতে পুদিনাপাতার রস খান, মধু-লেবুর রস গরম পানিতে মিশিয়ে ঢক ঢক করে নয়, ধীরে ধীরে পান করুন! ডাবের পানি পান করুন, গরম পানি পান করুন। এ ছাড়া বিবিধ খানাপিনার কথা বলা হচ্ছে, যেগুলো খেলেই নাকি করোনা আপনার ছয় ফুটের মধ্যে আসতে পারবে না। ভীষণ অবৈজ্ঞানিক ব্যাপার। না, যেগুলো আপনাকে খেতে বলা হয়েছে, সেগুলো খাওয়াটা অবৈজ্ঞানিক নয়। সেগুলো খাওয়ার জন্য যে উপায় বাতলানো হয়েছে, সেগুলো অবৈজ্ঞানিক। আপনাকে বুঝতে হবে, পুদিনাপাতার রস, লেবু ও মধুমিশ্রিত গরম পানি, ডাবের পানি, কালিজিরা—এগুলো এক–আধ দিনে কোনো উপকার করতে পারবে না আপনার।
এটা ঠিক যে এই খাবারগুলোর ভেষজ গুণ আছে এবং সেগুলো পরীক্ষিত। যুগের পর যুগ মানুষ এগুলো খেয়ে আসছে। উপকার না পেলে মানুষ এগুলো খেত না। মনে রাখতে হবে, মানুষের বিবর্তনের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে মানুষ সেগুলোকেই তার খাবারের পাতে রেখেছে, যেগুলো কোনো না কোনোভাবে শরীরের জন্য উপকারী। সে জন্যই আমরা কোনো বিষাক্ত খাবার খাই না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদের জন্য কোনো বিষাক্ত খাবার নির্ধারণ করে যাননি এবং আমাদের জেনেটিক কোড এ প্রবণতাকে কপি করে করে আজকের দিনে উপস্থিত হয়েছে। সে জন্য আমরা যা–ই খাই না কেন, সেটা আমাদের শরীরের কাজে লাগে বলেই খাই।
পুদিনাপাতার রস, ডাবের পানি, মধু ও লেবুর রসমিশ্রিত গরম পানি, কালিজিরা ভেজানো পানি আপনার শরীরের উপকারে আসবে। কিন্তু সেটা খেতে হবে দীর্ঘদিন ধরে, রবীন্দ্রনাথের মতোই প্রতিদিন নিয়ম করে। তাহলে যা খাচ্ছেন, তার উপকারী অনুষঙ্গগুলো আপনার শরীরের কাজে লাগবে। একদিন পুদিনাপাতার রস খেয়ে বলবেন, শরীরে প্রচুর 'ভাইটামিন' ঢুকে গেছে, আর না খেলেও চলবে। তাতে শুধু আত্মপ্রসাদ লাভ হবে, উপকার পাবেন না। কিংবা পেলেও ওই এক দিন খেয়ে যতটুকু পাবেন, ততটুকুই। তার বেশি নয়। অথচ এতে শক্তি আছে, আছে আয়রন, চর্বি, ভিটামিন সি, প্রোটিন ইত্যাদি। এগুলো শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। দীর্ঘদিন নিয়মিত পুদিনাপাতার রস খেলে এতে থাকা বিভিন্ন উপাদান আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করবে। তাই বলে শুধু পুদিনাপাতার রসই খেয়ে থাকবেন, তেমনটা করবেন না।
একই কথা বলা চলে মধুমিশ্রিত লেবুপানি, কালিজিরা ভেজানো পানি, ডাবের পানি, আদা, আমলকী ইত্যাদি খাবার ব্যাপারেও। যাঁরা ভেষজ চিকিৎসায় উৎসাহী, তাঁদের অনেকে প্রতিদিন সকালবেলা মুখ না ধুয়ে খালি পেটে এক/দুই গ্লাস কুসুম গরম পানি লেবুর রস মিশিয়ে পান করে থাকেন। টানা এক সপ্তাহ আপনিও পান করে দেখুন, আপনার পেটের গ্যাসের সমস্যা দূর হয়ে যাবে। লেবুতে থাকে ভিটামিন সি। সেটা শরীরের কাজে লাগে। কালিজিরাকে বিভিন্ন রোগের মহৌষধ বলা হয়ে থাকে এর গুণের জন্যই। এতে আছে প্রোটিন, ভিটামিন বি১, নিয়াসিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, কপার, জিংক, ফোলাসিন, নাইজেলোন, থাইমোকিনোন, স্থায়ী তেল ইত্যাদি।
কিডনি সুস্থ রাখার জন্য ডাবের পানি অত্যন্ত কার্যকর বলে সুবিদিত। কিন্তু যাঁদের কিডনির অসুখ আছে, তাঁদের জন্য ডাবের পানি বিষের মতোই ভয়ংকর। কাজেই বুঝেশুনে খেতে হবে। ডাবের ৯৫ শতাংশ পানি আর বাকি পাঁচ ভাগে আছে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরিক অ্যাসিড, ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড ইত্যাদি। ভিটামিন সি এর রাজা আমলকীতে আছে লেবু আর কাঁচা মরিচের চেয়ে বেশি ভিটামিন সি। এটি একাই কাজ করে না, বরং দেহের অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টকেও উজ্জীবিত করে তোলে। দুর্বল কোষকে সবল করার জন্য এর জুড়ি নেই।
ভাইরাল ভাইয়ের হাত ধরে আপনার কাছে আসা ভাইরাস বধের টোটকাগুলো শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী এবং দরকারিও বটে। কিন্তু সেগুলোতে থাকা বিভিন্ন খাদ্য উপাদান থাকে মিলি বা মাইক্রোগ্রাম হিসেবে। আপনি এক শ গ্রাম কালিজিরা খাচ্ছেন মানেই কিন্তু এক শ গ্রাম প্রোটিন, ভিটামিন বি১, নিয়াসিন কিংবা ক্যালসিয়াম পাচ্ছেন না। পাচ্ছেন হয়তো ১ গ্রাম কি তারও কম। অথবা কয়েক মিলি বা মাইক্রো গ্রাম। এই পরিমাণটা খুবই কম। কাজেই এক দিনে যা খাবেন, তাতে আপনার কিছুই হবে না। কিন্তু নিয়মিত খেলে এই মিলি বা মাইক্রোগ্রাম উপাদান আপনার উপকার করবে সেই বিন্দু বিন্দু করে সিন্ধু হওয়ার সূত্র মেনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দুই বছর করোনা প্রাদুর্ভাব নিয়ে আমাদের কাটাতে হতে পারে। আগামী দিনগুলোতে তারাই টিকে থাকবে, যারা আসলে ফিট। কাজেই এক দিন হুট করে খেয়ে টুক করে করোনা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিকল্পনা করুন। আর এই দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আপনি এখন যে টোটকাগুলোর কথা শুনছেন, সেগুলো নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এই অভ্যাসই আপনাকে করোনা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আর এগুলোর সুবিধা হলো, পাওয়া যায় হাতের নাগালে, বাজার করতে করতে পাওয়া যায়, বারান্দার টবেও পাওয়া যায়। দামেও সস্তা।
সহজে পাওয়া সস্তা জিনিস আপনার বাঁচার রসদ হতে পারে, তবে দীর্ঘদিনের নিয়মিত চর্চায়।