স্বাদের কাছে কোনো কিছুই ফেলনা নয়
বাঙালি নাকি খাবারের জন্যই বেঁচে থাকে! কথাটা খুব যে বেঠিক, সেটাও বলা যায় না। কিন্তু বাঙালির রসুইঘরে রান্না যে জমে ক্ষীর হয়ে যায়, সেটা কে বলবে? যিনি রাঁধতে জানেন, তিনি শুধু চুলই বাঁধতে জানেন না, খেতে আর খাওয়াতেও জানেন—এ সত্য বাঙালিকে না দেখলে বোঝা মুশকিল।
উদ্বেগ আর আতঙ্কের এই করোনাকালেও রান্নাঘর তো আর বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। বাসার বাইরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে তাই বরং আজ অবহেলায় পড়ে থাকা সবজি আর বাতিল খাদ্যদ্রব্যের দিকে নজর দেওয়া যাক। দেখে নেওয়া যাক মিতব্যয়ী বাঙালির আটপৌরে হিসাবকিতাব।
আটপৌরে বলছি; কারণ, আমাদের রান্নাঘরের ভাঁড়ারে যা পড়ে থাকে, তাকেই তরিবত করে সুস্বাদু খাবার রান্নার কলাকৌশল আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। ‘অস্ত্র জমা দিলেও ট্রেনিং জমা’দেওয়া যায় না। প্রয়োজনের সময় সেই ট্রেনিং আমাদের আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার রসদ জোগায় বটে।
আপনার ভাঁড়ার (এ যুগে ফ্রিজও বলতে পারেন) খুঁজে দেখুন পুরোনো মাছের মাথা আছে কি না। পেয়েছেন? এবার ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিন। একটু কষ্ট করে খুঁজে দেখুন পুরোনো সবজি মানে দীর্ঘদিন পড়ে আছে, খাওয়াই হয়ে উঠছে না, এমন কী আছে। কিছু তো পাবেনই। যেসব সবজি পেলেন সেগুলোকে মোটামুটি সমানভাবে কেটে ধুয়ে নিন। ফ্রাই প্যান নয়, কড়াই ভালো করে গরম করে নিয়ে তাতে তেল দিয়ে মাছের মাথা ভেজে নিন। তারপর আর কিছু তেল দিয়ে পাঁচফোড়ন দিন। চাইলে আপনি আদাবাটা, জিরাবাটাও দিতে পারেন। একটু ঘ্রাণ এলে কাঁচা মরিচ চিড়ে দিন। তারপর সবজি, লবণ, হলুদ দিয়ে নাড়তে থাকুন। পানি দেবেন না। এবার মাছের মাথাসহ সবকিছু কষাতে থাকুন ভালো করে। কষানোর শেষ দিকে এসে খুব সামান্য পানি দিন, যাকে বলে ‘হাত ধোয়া পানি’। দু–এক মিনিট রেখে তুলে ফেলুন। এই খাবারের নাম ছ্যাঁচড়া। বাঙালির এক বিস্মৃতপ্রায় আটপৌরে খাবার। পড়ে থাকা যেকোনো সবজি, যেকোনো মাছের মাথা দিয়েই রান্না করা যায় এ খাবার। ঠিকমতো রাঁধতে পারলে অমৃত হয়ে উঠবে।
বলে রাখি, ঘন্ট, লাবড়া, ভাজি, চচ্চড়ি—সেটা বাটি চচ্চড়িও হতে পারে, ছেচকি, পাঁচন, শুক্তো, পাকোড়া, ফুলুরি ইত্যাদি সবই সবজি রান্নার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি। কোনটা আপনি রাঁধবেন, সেটা আপনার পছন্দ। সব রান্নাই বাতিল হয়ে যাওয়া সবজি বা অনেক দিন পড়ে আছে কিন্তু খাওয়াই হচ্ছে না, এমন সবজি দিয়েও করা যায়। এর সঙ্গে শুধু মসলার ব্যবহারটা মনে রাখতে হবে। বাটা, ছ্যাঁচা, গোটা, গুঁড়া—বাঙালি রান্নায় এই চারভাবে মসলা ব্যবহার করা হয়।
পাকা রাঁধুনিদের সঙ্গে কথা বলার মজা হলো, রান্নার নাড়িনক্ষত্র জানা যায়। কোন সবজির সঙ্গে কোন সবজির মিল ভালো, কোন সবজিতে কোন মসলা দিতে হবে, কোন রান্নায় কেমন তাপ দিতে হবে—এগুলো হাতে–কলমে শেখা যায়। সবজি রাঁধতে গেলে এগুলো জানতেই হয়। যেমন পুরোনো বেগুনে ভাজবেন বেগুনি। তাতে কী দেবেন? বেসন আর আটার ব্যবহার না করে বেগুনিতে চালের গুঁড়া ব্যবহার করুন। তাতে বেগুনি মচমচে থাকবে দীর্ঘক্ষণ আর বেগুনের ওপরে এক ইঞ্চি পুরু স্তরও জমবে না। চালের গুঁড়ার সঙ্গে হালকা করে টেলে নেওয়া জিরা আর শুকনা মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে দিন। অথবা গোলমরিচের গুঁড়া মেশান। দেখবেন, তার স্বাদই অন্য রকম হয়ে যাবে।
আমাদের রান্নাঘরে সবচেয়ে বেশি পড়ে থাকে ডাঁটাজাতীয় শাকসবজি। এই ধরুন পুঁইশাক, ডাঁটাশাক কিংবা শজনে। যদি থেকেই যায়, তাহলে দেরি না করে সব একখানে করে সমানভাবে কেটে নিন। কিছু আলু, পটোল কিংবা করলা যোগ করুন। তারপর পাঁচফোড়নের ফোড়ন দিয়ে রেঁধে ফেলুন ঘন্ট। এ ঘন্টকে আরও সুস্বাদু করতে রান্না শেষের দিকে ভাজা ডালের বড়ি দিয়ে দিন। ঘন্টজাতীয় যা–ই রান্না করুন না কেন তাতে পাঁচফোড়ন বা জিরার ফোড়ন ব্যবহার করুন। দুটোতে দুই ধরনের স্বাদ পাবেন।
করোনাকালে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকেরা বলছেন বেশি করে শাকসবজি খেতে। তাই যেভাবে পারেন শাকসবজি খান। খাবার মুখরোচক করার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, সেগুলো ব্যবহার করুন। যেমন ধরুন, পুঁইশাক যদি বাসায় থাকে, তার পাতাগুলোকে আলাদা করে, কুচি কুচি করে কেটে জিরা মেশানো বেসনে ডুবিয়ে পাকোড়া বানিয়ে ফেলুন। স্বাদও পরিবর্তন হবে, শাকও খাওয়া হবে। তবে তেলের খাবার খুব বেশি না খাওয়াই ভালো এ সময়। আর পুঁইশাকের ডাঁটা কুচি কুচি করে তার সঙ্গে আলু, মলা মাছের শুঁটকি অথবা কাচকি-মলার মতো ছোট মাছ মিশিয়ে বেশি করে ঝাল দিয়ে রান্না করুন চচ্চড়িজাতীয় কিছু একটা। গরম ভাতের সঙ্গে খেয়ে দেখুন, ভুলতে পারবেন না।
কাঁচা কলা, পটোল, মিষ্টিকুমড়ার খোসা ও বিচি দিয়েও রান্না করা যায় সুস্বাদু খাবার। মিষ্টিকুমড়ার খোসা শুধু ভেজেই খাওয়া যায়। আর কাঁচা কলা ও পটোলের খোসার ভর্তার কথা তো সর্বজনবিদিত। কাঁচা কলা আর পটোলের খোসা সেদ্ধ করে ভালোভাবে চটকে নিয়ে বেসন অথবা চালের গুঁড়িতে মিশিয়ে চপ বানিয়ে ফেলুন। ভালো লাগবে।