কাঁসা-পিতলে বনেদিয়ানা
ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণের জন্য খাদ্য–পানীয় যেমন অনিবার্য, তেমনি তা রন্ধন আর পরিবেশনের জন্যও পাত্র-পেয়ালা দরকারি। যুগে যুগে রন্ধনপ্রণালিতে এসেছে বিচিত্র রকমের পরিবর্তন, তার সঙ্গে যুগে যুগে তৈজসপত্রেও এসেছে বৈচিত্র্য। উপকরণ থেকে শুরু করে গড়নে হাঁড়ি–পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাসে কত পালাবদল যে ঘটে গেছে এবং আজ পর্যন্ত ঘটে চলছে, তার লেখাজোখা নেই।
প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মাটি খুঁড়ে সুদূর অতীতের মৃৎভাণ্ড তুলে আনেন। হাল আমলের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেন তাপসহনীয় অভঙ্গুর কৃত্রিম তন্তুর গ্লাস, পেয়ালা প্রভৃতি। রং–নকশার চমকে বা মূল্য সাশ্রয়ে হাল আমলের সামগ্রী আগের জমানার জিনিসপত্রকে সরিয়ে দিয়ে সে জায়গা দখল করে নেয়—এটাই রীতি। কিন্তু তা হলে কী হবে, পুরোনো বলে সবকিছুই চিরতরে বাতিল হয়ে যায় না। পুরোনো জিনিস, প্রাচীন রেওয়াজ ফিরে ফিরে আসে তার ঐতিহ্যের গৌরব নিয়ে। তৈজসপত্রেও ইদানীং ফিরে আসছে আগের দিনের কাঁসা, পিতল ও তামার ধ্রুপদি ঐতিহ্য।
শহরে তো বটেই, গ্রামগঞ্জেও আজকাল আর খাবার টেবিলে কাঁসা-পিতলের থালা-গ্লাসের উপস্থিতি সচরাচর চোখে পড়ে না। চুলার ছাইয়ের সঙ্গে একটু তেঁতুল দিয়ে ঘষামাজা করা ঝকঝকে কাঁসা-পিতলের থালা-বাটি, চামচ, জগ, কলসি, বালতি গত শতকের মাঝামাঝিতেও প্রচুর দেখা যেত। বিয়েশাদি বা মুখে ভাতের নিমন্ত্রণে চমৎকার কারুকাজ করা কাঁসা–পিতলের জগ, কলসি, থালা-বাটির সেট উপহার দেওয়ার চল ছিল। বাড়ির বনেদিয়ানার পরিচয় প্রকাশ পেত কাঁসা–পিতলের সামগ্রীর মান ও পরিমাণের প্রাচুর্যের ওপর। এসব তৈজসপত্র কেবল যে বহুদিন টিকে থাকত, তা–ই নয়, পরিবারে মূল্যবান সম্পদ হিসেবেও গণ্য হতো। সোনা-রুপার অলংকারের পরে কাঁসা, পিতল ও তামার তৈজসপত্রই ছিল বাড়ির দামি সামগ্রী। সে কারণে আগে চোর-ডাকাতেরও নজর থাকত এসব থালাবাসনের প্রতি। নগদ অর্থ আর অলংকারের সঙ্গে সঙ্গে তস্করেরা বস্তা ভরে কাঁসা-পিতলের সামগ্রীও লুটে নিয়ে যেত।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কাঁসা-পিতলের সামগ্রীও বদলে যেতে থাকে। তার জায়গায় চলে আসে চিনামাটির থালা-বাটি। পরে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অভঙ্গুর ও তাপসহনীয় কাচ, পর্সিলিন, পাইরেক্স, মেলামিনসহ নানা রকম উপাদানের তৈজসপত্র। আর এখন তো স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলেও দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় প্লাস্টিকের সামগ্রীর জয়জয়কার। তা সত্ত্বেও কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র একেবারে উঠে যায়নি। কিছু কিছু বাড়িতে এখনো এসব থালাবাসন ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকে শখ করে এসব নতুন করে কিনে আনছেন। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, ইসলামপুর, তাঁতীবাজার, সূত্রাপুর এলাকায় কাঁসা-পিতলের থালাবাসনের দোকান রয়েছে। এ ছাড়া যদি কেউ ইচ্ছেমতো আকার–আকৃতি আর নকশায় থালা, বাটি, গ্লাস ইত্যাদি তৈরি করে নিতে চান, তবে ধামরাইয়ে যেতে পারেন। ধামরাইয়ের বিখ্যাত রথের মতো এখানকার কাঁসা-পিতলের সামগ্রীরও খ্যাতি রয়েছে।
কাঁসা, পিতল বা তামার তৈজসপত্র যে কেবল দীর্ঘদিন টেকসই, তা–ই নয়, এর বনেদিয়ানার ব্যাপারই আলাদা। দাম হয়তো একটু বেশি, তবে দাম দিয়ে তো আর ঐতিহ্যের বিচার চলে না। তাই বাড়ির খাবার টেবিলে হরেক স্বাদের খাদ্যসম্ভারের পাশাপাশি পাত্রের বৈচিত্র্য আনতে চাইলে যোগ করতে পারেন কাঁসা–পিতলের থালাবাসন।