কান পচা, কান পাকা
কান আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ভারসাম্য রক্ষা ও শ্রবণ ছাড়াও কানের স্বাভাবিক গঠন আমাদের চেহারার অংশ। তাই এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যত্নবান হওয়া উচিত। কানের দুটি সাধারণ রোগ হলো কান পচা ও কান পাকা।
কান পচা ও কান পাকা শুনতে একই রকম মনে হলেও বাস্তবে এ দুটি কিছুটা ভিন্ন বিষয়। কান পাকা বলতে বোঝায় মধ্যকর্ণের সংক্রমণ। অর্থাৎ কানে পর্দার পেছনে সংক্রমণ। আর কান পচা হলো কানের বাইরের অংশ অর্থাৎ যেটা আমরা দেখতে পাই, যাকে আমরা কান বলে জানি, সেটার সংক্রমণ ও পচে যাওয়া।
কেন কান পচে
কান পচা আমাদের দেশে খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। দুর্ঘটনায় কানে আঘাত লাগা, কামড়, কানে একাধিক দুল পরার জন্য ছিদ্র করা ইত্যাদি ঘটনার ফলে কান পচা নিয়ে হাসপাতালে প্রচুর রোগী আসে।
আমাদের কানের বাইরের অংশটি একটি নরম হাড়ের তৈরি কাঠামো। এটা চামড়ার নিচের অংশ থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে। কানে আঘাতের ফলে চামড়ার নিচের অংশ ও এই নরম হাড়ের মাঝে একধরনের তরল জমা হতে থাকে। দীর্ঘক্ষণ ধরে এই তরল জমা হয়ে থাকলে কানের নরম হাড় পুষ্টি পায় না এবং পচতে শুরু করে। আবার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও জিনিসপত্র দিয়ে কানে একাধিক দুল পরার জন্য ছিদ্র করলে অনেক সময় কানের নরম হাড়ে পচন ধরে। এ ছাড়া কানের বাইরের অংশের সংক্রমণ, চর্মরোগের প্রতি অবহেলা, নিজের পরিচ্ছন্নতার প্রতি বেখেয়াল হলেও এ সমস্যা হতে পারে।
উপসর্গ
এ সমস্যার শুরুতে কান জ্বলতে পারে বা গরম লাগার অনুভূতি হতে পারে। কানের যে স্বাভাবিক নরম ভাব, তা চলে গিয়ে কিছুটা শক্ত অনুভূত হতে পারে। কানের বাইরের অংশ পুরোটা বা অংশবিশেষ ফুলে যেতে পারে। সবকিছুর সঙ্গে জ্বর বা গায়ে ব্যথাও থাকতে পারে।
কানের নরম হাড়ের কাঠামোটা টিকিয়ে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একবার পচন ধরে গেলে এটাকে থামানো কষ্টকর। আর এই নরম হাড়ের কাঠামো নষ্ট হয়ে গেলে কানের আর স্বাভাবিক আকার ফিরিয়ে আনা যায় না। কান কুঁচকে অনেকটা লাউ ফুলের মতো হয়ে যায়।
চিকিৎসা
কানের স্বাভাবিক আকার ফিরিয়ে আনার জন্য যে ধরনের অপারেশনের প্রয়োজন হয়, তা বেশ খরচের ও সময়সাপেক্ষ। আমাদের দেশে খুব বেশি জায়গায় সে ধরনের অপারেশন হয় না। তাই এ সমস্যা প্রতিরোধে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। প্রথমত, কানে একাধিক দুল পরার ছিদ্র করা থেকে বিরত থাকা। একান্তই করার ইচ্ছা থাকলে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে অথবা বিশ্বস্ত ও পরিচ্ছন্ন পারলারে করা উচিত। দুর্ঘটনার কারণে কানে আঘাত পেলে তা অবশ্যই দক্ষ কারও মাধ্যমে চিকিৎসা করানো উচিত। তাৎক্ষণিকভাবে দক্ষ কারও মাধ্যমে চিকিৎসা করানো সম্ভব না হলে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে দ্রুততম সময়ের মাঝে তা দক্ষ চিকিৎসকের মাধ্যমে ফলোআপ করানো উচিত। কানের আঘাতের সেলাই করার ক্ষেত্রে কখনোই কানের নরম হাড়ের ওপর সেলাই করা যায় না। এ ছাড়া দুর্ঘটনার ফলে কানে আঘাত পেলে তাতে দ্রুত বরফ বা ঠান্ডা পানি ঠেসে ধরা ভালো। এতে কানের নরম হাড় ও চামড়ার মধ্যবর্তী স্থানে তরল জমে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে।
কান পাকা যেহেতু মধ্যকর্ণের সংক্রমণ, তাই এতে কানের পর্দা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কান পাকা রোগের মধ্যে একটি ধরন আছে, যেখানে কান কিছুদিন শুকনা থাকে আবার কিছুদিন পরপর পাকে, পানি বা পুঁজ বের হয়। আবার আরেক ধরনের কান পাকা রোগ আছে, যেখানে কান কখনোই শুকায় না। যে ধরনের কান পাকা রোগে মাঝেমধ্যে কান শুকনা থাকে, সেসব ক্ষেত্রে আক্রান্ত কানটিতে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে পর্দা লাগিয়ে ফেললে কান পাকার এই বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
কেন লাগাবেন কানের পর্দা
মূলত কান পাকা প্রতিরোধ করা, কানের ভেতরের প্রত্যঙ্গগুলোকে রক্ষা করা এবং শোনার ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা না গেলেও কিছুটা ভালো করার জন্যই কানে পর্দা লাগানো হয়। কানের পর্দা হলো পরিবেশ এবং মধ্যকর্ণের মাঝে একমাত্র দেয়াল। এটা না থাকলে কানের ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে।
সাধারণত কানের আশপাশ থেকে চামড়ার নিচের কিছু অংশ নিয়ে পর্দার গ্রাফট তৈরি করা হয়। তারপর সেই গ্রাফটের ওপর পর্দা তৈরি হতে দুই সপ্তাহ থেকে এক মাস সময় লাগে। এ সময়ে যে চিকিৎসক নিয়মিত অপারেশন করেছেন, তাঁর কাছেই কান পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া দরকার। অপারেশনের আগে ও অন্তত তিন মাস পর পরীক্ষা করিয়ে শ্রবণশক্তির উন্নতি হয়েছে কি না তা দেখা যায়।
অপারেশনের ঝুঁকি
অপারেশনের কিছু ঝুঁকিও আছে। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাফট ফেইলর অর্থাৎ পর্দা তৈরি না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কয়েক মাস পর আবার চেষ্টা করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রবণশক্তি আরও কমে যেতে পারে। অপারেশন যেদিকে করা হয়েছে, সেদিকে জিবের পেছন ভাগের স্বাদ নেওয়ার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। কানে অপারেশনের পর কিছুদিন শোঁ শোঁ শব্দ হতে পারে। মাথা ঘোরানো ভাব হতে পারে। মুখের পাশে অবশ অবশ লাগতে পারে।
তবে আশার কথা হলো ঝুঁকি বা অপারেশন ফেইলর হওয়ার হার খুবই কম। আমাদের দেশে এখন বেশ অল্প খরচেই এই অপারেশন অনেক নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ সাফল্যের সঙ্গে করছেন। তাই অপারেশন প্রয়োজন হলে আশাবাদী হয়ে, বুকে সাহস নিয়ে এই অপারেশনে রাজি হতে পারেন। শুভকামনা থাকল।
লেখক: এমবিবিএস (ইউএসটিসি-১৮), বিসিএস (স্বাস্থ্য), ডিএলও ট্রেইনি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।