দুর্বলতাই আমার শক্তি
>
মডেল—শব্দটা শুনলেই মাথায় আসে গ্ল্যামার ও ফ্যাশন-দুনিয়ার কথা। আলো–ঝলমলে ফ্যাশন মঞ্চ আর সেখানে সুন্দর মুখের উপস্থাপন। দক্ষিণ এশিয়ার নারী মডেল মানে থাকতে হবে ঝলমলে চুল, টানা টানা চোখ আর খাড়া নাক। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালেন দেশি এক মডেল, নাম মৌসুমী হুদা, যাঁর মাথায় কোনো চুল নেই। এই টাকমাথা নিয়েই দেশের ফ্যাশনশিল্পে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।
১৮ জুলাই ২০১৬। ঢাকার পাঁচতারকা হোটেল লা মেরিডিয়ানে হলো একটি ফ্যাশন শো। আয়োজক ছিল ইন্টারন্যাশনাল কটন কাউন্সিল (সিসিআই)। যেখানে দেশের শীর্ষ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অংশ নেয়। অতিথিদের মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কটন ইউএস ও ন্যাশনাল কটন কাউন্সিলের সদস্য দল। মিলনায়তন ভর্তি দর্শক। স্বচ্ছ কাচের ফ্যাশন মঞ্চ। আলো জ্বলল। দেখলাম একঝাঁক মডেল এসে দাঁড়ালেন। একজন নজর কাড়লেন সহজেই। ওই মডেল আলাদা করে প্রশংসা পেলেন দর্শকদের।
ফ্যাশন মঞ্চে দাঁড়ানো সেই মডেলের ন্যাড়া মাথা। তাতে নানা রকম ট্যাটু আঁকা। পশ্চিমা সাজপোশাকে কোরিওগ্রাফার আসাদ খানের নির্দেশনায় সেদিন ফ্যাশন মঞ্চ মাত করেছিলেন নতুন এই মডেল মৌসুমী হুদা। এরপর প্রতি বছর নিয়মিত বড় বড় ফ্যাশন শোতে দেখা পেয়েছি তাঁর। কখনো টাকমাথায়, কখনো ভরা চুলে! যেটা দেখে যে কারও ধন্দে পড়ে যাওয়ার কথা। তবে মৌসুমী কখনো লুকাতে চান না তাঁর টাকমাথা। এই টাক তিনি ইচ্ছে করে করেননি। ছোটবেলায় টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে তিনি হারিয়েছেন চুল। এর পরে মাথায় আর চুল গজায়নি।
ছোটবেলার দুর্ঘটনা
২ মার্চ ঢাকার মিরপুরে বসে মৌসুমী ফ্যাশন শোর রানওয়েতে ওঠার স্মৃতি বলতে গিয়ে ২০১৬ সালের সেই শোয়ের কথা বললেন। আলাদা করে এদিনের কথা বলছিলেন কারণ, এটাই ছিল স্ট্রাগল করা মডেল মৌসুমীর প্রথম কোনো বড় কাজ।
মৌসুমীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজশাহী শহরে। ব্যবসায়ী বাবা আবদুল আলী আর গৃহিণী মা আজরা বেগমের চার সন্তানের মধ্যে বড় মৌসুমী। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় টাইফয়েড জ্বর হলে মৌসুমীর চুল পড়ে যায়। কয়েক মাসের মধ্যে সে চুল ফিরে আসে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর আবার জ্বরে পড়েন। ডাক্তার জানান আবারও টাইফয়েড হয়েছে মৌসুমীর। এবারও চুল ঝরে যায়, সঙ্গে ভ্রুও। বেশ কিছুদিন অসুস্থ থেকে সেরে ওঠেন তিনি। স্কুলে যাওয়া শুরু করেন। দিন যায়, মাস যায়, বছর শেষ হয় কিন্তু তাঁর চুল ও ভ্রু আর গজায় না। মা-বাবা নানা রকম ওষুধ খাওয়ান, কাঁচা ডিম, পেঁয়াজের রস মাথায় দিয়ে দেন, কবিরাজের ওষুধ আনেন। কিছুতেই চুল ফেরে না। গার্লস স্কুলে পড়ার দরুন এ নিয়ে খুব বেশি মন খারাপ হতো না মৌসুমীর। তবে ঝামেলা হতো কোথাও বেড়াতে গেলে বা বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণে। বাবা কিনে আনেন একটি সাধারণ পরচুলা। যেটা দেখলেই বোঝা যায়, আর মানুষও হাসাহাসি করতে থাকে। তখন খুব মন খারাপ হতো কিশোরী মৌসুমীর।
টিভিতে যখন ফ্যাশন শো হতো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতেন মৌসুমী। বড় বড় বিলবোর্ড দেখে সেখানে নিজেকে কল্পনা করতেন। তবে প্রকাশ করেননি কারও কাছে। মৌসুমী বলেন, ‘একে তো রাজশাহীতে থাকি, তার ওপর মাথায় চুল নেই। তাই মনের ইচ্ছাটা দমিয়ে রাখতাম।’
২০০৭ সালে রাজশাহী বহুমুখী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন রাজশাহীর বরেন্দ্র কলেজে। এবার কিছুটা ভয় পেলেন। এতদিন মেয়েদের স্কুলে পড়লেও এবার তো নানা রকম নতুন মানুষ থাকবে ক্লাসে। মৌসুমী মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে পরতে শুরু করলেন। এইচএসসি পাস করে রাজশাহী সিটি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তিও হয়েছিলেন। আবারও একটি দুর্ঘটনায় পড়লেন, আঘাত পেলেন মাথায়। ডাক্তারের পরামর্শ—আপাতত মাথায় চাপ লাগে এমন কাজ করা যাবে না। পড়াশোনাও তাই বন্ধ রাখতে হয়। এর মধ্যে কিছুদিন বিভিন্ন দোকানে চাকরি করেন মৌসুমী। তবে একটা সময় সেটাও ছেড়ে দেন।
মিশন ইচ্ছেপূরণ
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে বন্ধু দম্পতি সান ও নূপুরের ডাকে মৌসুমী ঢাকায় আসেন। মিরপুরের কাজীপাড়ায় ওই বন্ধুদের বাসায় থেকেই একদিনের জন্য একটি কাজের খোঁজ পান। সেটা ছিল একটি দোকানের উদ্বোধন। ১ হাজার টাকা আয় করেন তিনি। মৌসুমী বলেন, ‘সানকে আগেই বলে রেখেছিলাম কোনো কাজ পেলে ঢাকা আসতে চাই। ওদের প্রতি আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা। এরপর ওই বাসায় কয়েক দিন থেকেই একটি মেসে উঠলাম শোভা শাহরিয়ার নামে একটি মেয়ের সঙ্গে। শোভা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন আবার বিভিন্ন বিজ্ঞাপনচিত্র ও নাটকে কাজ করতেন। শোভার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যেতাম, সেও আমাকে কাজিন বলে পরিচয় করিয়ে দিত।’
এর মধ্যে আরেকজন নতুন বন্ধু হয় মৌসুমীর। দ্রুত তিনি কাছের বন্ধু হয়ে ওঠেন। তাঁর মাধ্যমে খোঁজ পেলেন মডেল ও কোরিওগ্রাফার বুলবুল টুম্পার গ্রুমিং স্কুলের। তিন মাস সেখানে ক্লাস করে শিখলেন মডেলিংয়ের নানা বিষয়। তবে শুরুর দিকে কোনো কাজ পাচ্ছিলেন না। অনেক অফিসে পোর্টফোলিও জমা দিলেও কেউ ডাকলেন না। কেউ যখন ডাকতেন না তখন বুলবুল টুম্পা তাঁর ফ্যাশন শোতে মৌসুমীকে সহকারীর কাজ দিতেন। এভাবেই অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তবে ফটোশুটে কেউ ডাকেন না।
‘কষ্ট পেতাম। হতাশ লাগত। তবে আমি পারব, এই বিশ্বাস সব সময় ছিল। এর মধ্যে একদিন ফ্যাশন সাময়িকী ক্যানভাস থেকে ডাক এল। তারা আমার ছবি তুলবে। তারা পরচুলা ছাড়াই আমার ছবি তুলেছিল। এরপর দেখি পরের মাসের প্রচ্ছদে আমার ছবি! খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন। এর আগে নগর বাউল জেমস ভাইয়ের একটা নিজস্ব ফটোশুটের কাজও করেছিলাম।’ বললেন মৌসুমী হুদা।
এখনো যে নিয়মিত মডেলিং করার সুযোগ পান তা নয়, তবে শুরুর চেয়ে অবস্থা অনেকটা বদলেছে। মৌসুমী মনে করেন, যেহেতু এতদিন কোনো বাল্ড হেডেড বা টাকমাথার মেয়ে মডেল হিসেবে ছিলেন না, তাই হয়তো লোকের শুরুতে খটকা লাগে। আবার এটা দেখেই ডাকেন।
মৌসুমী বলে যান, ‘আগে ভাবতাম সব সময় পরচুলা পরেই রানওয়েতে হাঁটব। কিন্তু এখন মনে হয় এটাই তো আমার শক্তি। দুর্বলতা ভেবে মাথায় পরচুলা পরার কি আছে!’ পরক্ষণেই মৌসুমী আরেকটি তথ্য দিলেন, ‘তবে অভিনেতার যেমন নানা চেহারায় নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়, আমাদেরও তাই। মডেল হিসেবে আমারও কখনো পরচুলা পরতে হতে পারে, সেটা আমি পরবও।’
তবে মৌসুমী ভালোবাসেন পরচুলা ছাড়াই হাঁটতে। ফ্যাশন শো করছেন নিয়মিত। দেশের সবচেয়ে বড় ফ্যাশন শো হিসেবে পরিচিত ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকেও প্রতি বছর হাঁটছেন। তবে যেহেতু এই আয়োজন ইউনিলিভারের শ্যাম্পুর ব্র্যান্ড ট্রেসেমের, তাই পরচুলা পরেই হাঁটতে হয়েছে মৌসুমীকে। আবার ফ্যাশন হাউস জুরহেমের ফ্যাশন শোতে মৌসুমী হেঁটেছেন চুল ছাড়াই।
মৌসুমী থেকে মৌসুমী হুদা
ঢাকায় যে বন্ধু গ্রুমিং স্কুলে ভর্তির খোঁজ এনে দিয়েছিলেন তাঁর নাম তানজিদ–উল–হুদা। যেকোনো সংকটে ও হতাশায় মৌসুমীর পাশে থেকেছেন তানজিদ। বন্ধুত্ব থেকেই তাই প্রেমের দিকে ঝোঁকেন দুজনে। শুরু থেকেই মৌসুমী নিজের সবটা খোলাখুলি বলে দিয়েছিলেন। কয়েক বছরের চেনাজানার পর গত বছরের ১৫ মার্চ দুই পরিবারের মাধ্যমে বিয়ে হয় মৌসুমী-তানজিদের। মৌসুমী বলেন, ‘সে আমাকে খুবই ভালোবাসে। আমার আজকের এই অবস্থানের পেছনে তাঁর অবদানই সবচেয়ে বেশি।’
এখনো কাজে যাওয়ার সময় স্বামীর পূর্ণ সমর্থন পান। বিয়ের পর থেকে মৌসুমী নিজের নামের শেষে স্বামীর নামের অংশ হুদা জুড়ে নিয়েছেন ভালোবাসা থেকেই।
স্বপ্ন আরও এগিয়ে যাওয়া
ছোটবেলার পছন্দের বিষয়টা বড় হয়েও অনেকের কাছে থাকে অধরা। প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও মৌসুমী হুদার বেলায় তেমনটা ঘটেনি। নিজের স্বপ্ন ছুঁয়েছেন তিনি। তবে তিনি মনে করেন, ‘স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছেছি। এটা ধরে রাখতে চাই। আরও বড় স্বপ্ন দেখি। দেশ পেরিয়ে বিদেশেও অনেকে জানুক আমাকে। দেখুক আমার কাজ।’
দেশের নামকরা কোরিওগ্রাফার আজরা মাহমুদও উৎসাহ দেন মৌসুমীকে উইগ (পরচুলা) ছাড়া হাঁটতে। শোয়ে আয়োজকদেরও মৌসুমীর হয়ে অনুরোধ করেন। এসব দেখে নিজের ভাবনাটা আরও প্রসারিত হয় মৌসুমীর।
লা মেরিডিয়ান হোটেলের সেই প্রথম শোতে যে হাততালি আর উৎসাহ পেয়েছিলেন, সেটাকে এরই মধ্যে বাড়িয়ে ফেলেছেন কয়েক গুণ। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিজেকে পরিচিত করাতে চান আন্তর্জাতিক মডেল হিসেবে। সেখানে যেকোনো দুর্বলতাকে শক্তি হিসেবেই রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ নিতে চান।