রাগবি প্রশিক্ষক মাহফিজুল
দৈবাৎ একটা ঘটনায় মাহফিজুল ইসলামের পা পড়েছিল রাগবি খেলার মাঠে। সেটা ২০১১ সালের ডিসেম্বরের কথা। মাহফিজুল ঢাকায় বেড়ে উঠলেও ক্রিকেটার হিসেবে নিজ জেলা শরীয়তপুরে পরিচিত ছিলেন। সেই সূত্রেই শরীয়তপুর জেলা রাগবি দলের অধিনায়ক শহীদুল ইসলামের ফোন পেলেন মাহফিজুল। জাতীয় রাগবি প্রতিযোগিতায় শরীয়তপুর জেলার হয়ে খেলার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হলো তাঁকে। তখনো রাগবি সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তাঁর। তবে নতুন একটি খেলায় অংশ নিতে প্রস্তাবটি লুফে নেন মাহফিজুল।
সেই প্রথম মাঠে নেমে রাগবির প্রতি আগ্রহটা বুঝে ফেলেন মাহফিজুল। তখন তিনি আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র। কয়েক মাস পরই এসএসসি পরীক্ষা। ক্রিকেটপাগল এই ছেলের চোখ হঠাৎ করে আটকে গেল পত্রিকার পাতায়। আন্তস্কুল রাগবি টুর্নামেন্টের জন্য দল নিবন্ধন চলছে। সেসব না ভেবেই নিজের স্কুলের একটি দল তৈরি করে টুর্নামেন্টে নাম লেখালেন। সেই পর্বে দল হারলেও মাহফিজুলের খেলা আর সাংগঠনিক দক্ষতা নজর কাড়ল জাতীয় রাগবি ফেডারেশন ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মৌসুম আলীর। একদিন তাঁকে ডেকে ঘাড়ে হাত রেখে বাহবা দিলেন।
এরপর রাগবি মাঠকেই ঠিকানা করে নিলেন মাহফিজুল। রাগবিই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে ২০১২ সালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেন মাহফিজুল। রাগবি মাঠে নিয়মিত হয়ে গেছেন তত দিনে। পরের বছরই শুরু হলো তাঁর কোচিং ক্যারিয়ার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাভার ক্যান্টনমেন্টের সেনাসদস্যদের রাগবি প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন মাহফিজুল। এর পাশাপাশি ২০১৫ সালে কোচিং করিয়েছেন ইডেন মহিলা কলেজের খেলোয়াড়দের। পরবর্তী বছর তিনি যুক্ত হন বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন ইউনিয়নের সঙ্গে। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় রাগবি দলের স্কিল ডেভেলপমেন্ট কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
বছর যত গড়িয়েছে, অভিজ্ঞতার পাল্লা তত ভারী হয়েছে ২৬ বছর বয়সী মাহফিজুলের। ২০১৮ সালের অক্টোবরে লেভেল-২ রাগবি কোচের মর্যাদা পান (বর্তমানে বাংলাদেশে আরও একজন লেভেল-২ রাগবি কোচ হিসেবে যুক্ত হয়েছেন)। এরপর থেকেই তিনি প্রস্তুতি নিতে থাকেন ওয়ার্ল্ড রাগবি এডুকেটর হওয়ার জন্য। মাঠে পেশাদার কোচদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অনলাইনে বিভিন্ন কোর্স সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর চলতি বছর বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন ইউনিয়ন মাহফিজুলকে ওয়ার্ল্ড রাগবি এডুকেটর হিসেবে আবেদনের জন্য মনোনীত করে। জুলাই মাসের শুরুতে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে যান মাহফিজুল। ওয়ার্ল্ড রাগবি এডুকেটর সনদ প্রাপ্তির জন্য সেখানে ৩৮টি ধাপ সম্পন্ন করতে হয় তাঁকে। পেশাদার কোচদের প্রশিক্ষণের প্রমাণ, অনলাইন মডিউল কোর্সগুলোর পরীক্ষাসহ বেশ কয়েকটি ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নেন মাহফিজুল।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত ২৬ অক্টোবর পেয়েছেন রাগবির নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড রাগবি’ থেকে ওয়ার্ল্ড রাগবি এডুকেটর বা প্রশিক্ষকের সনদ। দেশে অপ্রচলিত এই খেলায় প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। মাহফিজুল বলেন, ‘আগে বাংলাদেশে কোনো ওয়ার্ল্ড রাগবি এডুকেটর ছিল না। ওয়ার্ল্ড রাগবি সমমানের রাগবি কোচিংয়ের জন্য আমরা বিদেশি কোচের অপেক্ষায় থাকতাম। কিন্তু এখন আমি নিজেই এ ধরনের কোচিং করাতে পারব। এ ছাড়া ওয়ার্ল্ড রাগবি এডুকেটররা বিশ্বের যেকোনো স্থানেই ওয়ার্ল্ড রাগবি সমমানের রাগবি কোচিং কোর্স পরিচালনা করতে পারবেন। পারেন কোর্সের সনদেও স্বাক্ষর করতে।’ তবে ওয়ার্ল্ড রাগবি সমমানের কোচিং ও সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড রাগবি কর্তৃক কোচিংয়ের সার্বিক মান যাচাইয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে বলে জানান মাহফিজুল।
ব্যক্তিগত প্রাপ্তির আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকতে চান না মাহফিজুল। বরং তিনি চান সারা দেশে রাগবিকে ছড়িয়ে দিতে। ব্যক্তিগত যেকোনো অর্জনের চেয়ে সামগ্রিকভাবে দেশের রাগবির উন্নয়ন বেশি জরুরি বলেই মনে করেন অভিজ্ঞ এই প্রশিক্ষক। দেশব্যাপী রাগবিকে ছড়িয়ে দিতে বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন ইউনিয়নের সহযোগিতা নিয়ে একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। উদ্যোগটির নাম দিয়েছেন রাগবি অ্যাটলিস্ট ওয়ানস আ মানথ (রাওম)। অর্থাৎ মাসে অন্তত একবার রাগবি খেলতে হবে। এই উদ্যোগের আওতায় যশোর, মৌলভীবাজার, ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে রাগবি খেলা শুরু হয়েছে। তাঁর এই উদ্যোগটি চলতি বছর মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘গ্রোয়িং দ্য গেমস কনফারেন্স’ নামক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের আয়োজক ছিল ‘এশিয়া রাগবি’।
রাগবিকে দেশে জনপ্রিয় করতে অ্যাসোসিয়েশনের সহায়তায় আরও অনেক কাজের পরিকল্পনা আছে তাঁর। সে জন্য প্রয়োজন রাগবি মাঠের। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তো মাঠের চাহিদার কথা জানিয়েছেন মাহফিজুল। তবে তাঁর ব্যক্তিগত চাহিদা? প্রশ্ন রাখা হয় মাহফিজুলের কাছে। একগাল হেসে সরল উত্তরে জানিয়ে দিলেন, ‘ব্যক্তিগত চাহিদা কিংবা প্রত্যাশা যা–ই বলুন না কেন, ২০২১ সালের মধ্যে নিজেকে লেভেল-৩ কোচ ও ওয়ার্ল্ড রাগবি এডুকেটর হিসেবে দেখতে চাই।’