আরেক রাতারগুল
হাওরের নাম দামারি। প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের যাতায়াত এই হাওরের পাড় ঘেঁষে। অনেকে চলন্ত গাড়ি থেকে দামারিকে চোখে দেখেই মুগ্ধ হন, সেই মুগ্ধতার পরশ মেখেই চলে যান জল-পাথরের বিছনাকান্দি আর ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের পথে।
বর্ষার তপ্ত দুপুর। সাতপাঁচ না ভেবে আমরা চার বন্ধু মোটরবাইকে চেপে রওনা দিয়েছি। তখনো গন্তব্য অজানা। উদ্দেশ্যহীন যাত্রা ভেবে বাইকের পেছনে বসা বন্ধুটি বলে উঠল, ‘আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?’
আগ্রহের পারদ চড়াতে কোনো উত্তর দিইনি তাকে। তবে যখন সেই একই প্রশ্ন বার কয়েক করে ফেলল, তখন আশ্বস্ত করতেই বললাম, ‘এই তো কাছে, খুব কাছেই। সেখানে সুন্দর একটি বন আছে, জলে ভাসা সবুজ বন।’ কথা শুনে বন্ধুর নতুন জায়গা ঘুরে দেখার আগ্রহের মাত্রা যেমন বাড়ল, তেমনি বলে উঠল, ‘আরেক রাতারগুল নাকি?’
সত্যিই দামারি হাওর যেন আরেক রাতারগুল। সেদিন হঠাৎ যাত্রাটা ছিল জলাবন দর্শনের উদ্দেশ্যেই। সিলেট শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার সড়কপথের দূরত্ব। জায়গাটা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দীরগাঁও ইউনিয়নের শালুটিকরে। নাম দামারি হাওর। হিজল-করচ অর্ধডুবো হয়ে আছে সে হাওরে। গোয়াইন আর সারি নদের প্রতিবেশী দামারি।
শালুটিকর বাজার তো অনেকের চেনা। বাজারের উত্তর-পশ্চিমেই অবস্থান দামারি হাওরের। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক এই হাওরের ঘা ঘেঁষে যাতায়াত করেন। কেউ হয়তো চলন্ত গাড়ি থেকে আড়চোখে হাওরটি দেখেই চলে যান জল-পাথরের বিছনাকান্দি আর পাথররাজ্য ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরে।
সেদিন মোটরবাইকে আধঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছাই শালুটিকরের গোয়াইন নদের ঘাটে। মোটরবাইক দুটি পরিচিত একজনের জিম্মায় রেখেই নৌকার খোঁজ করি। মাঝি সুলতান মিয়া তাঁর ছোট নৌকা নিয়ে ঘাটেই বসে ছিলেন। মৃদু ঢেউয়ে দোল খাচ্ছিল তাঁর নৌকাটি। ভাড়া মিটমাট করে উঠে পড়ি সুলতান মাঝির নৌকাতেই। নৌকায় বসতে না বসতেই মাঝি শোনালেন আফসোসের কথা, ‘কত সুন্দর দামারি! মানুষ চোখ মেলে না দেখে পাশ দিয়ে চলে যায়, কেউ নাও নিয়ে নামেও না।’
আমাদের নৌকা মিনিট দুই এগোতেই মন উঁকি দেয় রবিঠাকুরের সেই চিরচেনা পঙ্ক্তিমালায়, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।’
ঘাট থেকে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই হাওরের মধ্যখানে পৌঁছে যাই। মাঝি ছাড়া হাওরের অতিথি বলতে তখন আমরা চারজনই। হিজল-করচসহ নানা জাতের গাছের দখলে হাওরের চারপাশ। তবে দামারির বুক যে অসীম জলরাশি ধারণ করে রেখেছে, সেটাও বোঝা গেল কিছুক্ষণ পর। দূর থেকে তো সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক হ্রদের মতোই দেখাচ্ছিল দামারিকে। এখন কাছে এসে দেখা মিলল অন্য রূপ। আর ওই যে হাওর লাগোয়া ছোট-বড় দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষশোভিত বাড়িগুলো, সেগুলোও কেমন মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিল।
কিছুটা এগিয়ে দেখা মিলল স্বচ্ছ জলে নৌকা বাইতে আসা হাওরপাড়ের শিশুদের একটি দলের। এই হাওরেই তাদের বেড়ে ওঠা। আরও খানিকটা এগোতেই চোখে পড়ল হাওরপাড়ের বাসিন্দারা কেউ মাছ ধরছেন, কেউ আবার স্বচ্ছ পানিতে ঝুপ করে নাইতে নেমেছেন। দামারির পানি এতই স্বচ্ছ যে আকাশ দেখতে পানিতে তাকালেই হয়। গাছগুলো বেশ ডালপালা ছড়িয়ে আছে। তাই নৌকা নিয়ে ভেতরে যাওয়ার জো নেই। দলের একজন তো বলেই উঠল, গাছগাছালির ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই, দূর থেকেই দামারি সুন্দর!
কিন্তু জলাবন তো কাছে ডাকছে। আমরা ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করি। ঠিক তখনই ‘সাপ, সাপ...’ বলে নৌকা থেকে লাফ দেওয়ার উপক্রম আমাদের এক সঙ্গীর। সাপের ভয় তাঁকে এতই পেয়ে বসল যে জলাবনের ভেতরে আর যাওয়া হলো না। বইঠার জাদুতে নৌকাকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন মাঝি। সেখানে বসেই হাওর থেকে অদূরে দেখা মিলল মেঘালয়ের পাহাড়ের। পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসা ঝরনাধারাও দৃষ্টি কাড়ল। নৌকার তলায় ঢেউয়ের শব্দে অন্য রকম এক আবহ তৈরি হলো। নীরব প্রকৃতি আর মৃদুমন্দ হাওয়ায় আমার মতো ঘুমকাতুরের পক্ষে চোখ মেলে রাখা চ্যালেঞ্জ মনে হলো! এরই মধ্যে নিস্তব্ধতা ভাঙে গাছে বসে থাকা পাখির ডাকে, হঠাৎ ফুড়ুৎ করে উড়াল দেয় একঝাঁক পাখি।
কোলাহলহীন শান্ত-স্নিগ্ধ দামারি হাওর ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদল করে চলে। আমরাও সেই রূপে আচ্ছন্ন থাকি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল ঠাঁই নেয় সন্ধ্যার কোলে। টুপ করে সূর্যটা ডুব দেয়। অন্ধকারকে স্বাগত জানানোর মুহূর্তে আমরাও বিদায় জানাই দামারি হাওরকে।