কিশোরী মনের দোলাচল
>হঠাৎ ভালো লাগা, উচ্ছল হাসি, আবার হঠাৎ বিরক্তি, কথার হেরফেরে চোখে পানি চলে আসা, কপট রাগে দরজার কপাট লাগিয়ে দেওয়া—মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এগুলো বয়ঃসন্ধিকালের বৈশিষ্ট্য। এ সময় কিশোরীর মনে চলতে থাকে দোলাচল। তাই তাকে তার মতো করে বোঝা চাই।
পাড়ার ২১ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলেটি যখন মাথা নিচু করে হেঁটে যান, ১৬ ছুঁয়ে যাওয়া কিশোরী মেয়েটির মনে তখন যেন কাঁপন ওঠে। শীতের সকালে আমলকীর ডালে যেমন আলোর নাচন আসে, অনেকটা তেমন। গোপনে গোপনে এমন ভালো লাগা আগেকার মতো ফেসবুকের এই যুগেও চলে। কোনো কোনো কিশোরী সেই ভালো লাগার কথা প্রকাশ করতে পারে না। বয়ঃসন্ধিতে তো এমনই হওয়ার কথা। হঠাৎ বিরক্তি, কথার হেরফেরে চোখে পানি চলে আসা, কপট রাগে দরজার কপাট লাগিয়ে দেওয়া—সবই তো এই ‘বয়সের দোষ’। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা।
কদিন আগে যাকে ছোট হিসেবে গণ্য করা হতো পরিবারে, তার আচমকা এই পরিবর্তন পরিবারও মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে মায়ের সঙ্গে, বড় বোন থাকলে তাঁর সঙ্গে এঁড়ে তর্ক লেগে যায়। কোনো খবরদারি, নজরদারি বা শাসনে তাকে আটকাতে গেলেই বাধে যত বিপত্তি। কিশোরী মেয়েটির নিজের কাছেও নিজেকে অচেনা লাগে। মনে হতে থাকে, অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই তার। বাড়ির কিশোরী মেয়েটির কাছে মা–বাবাকে দূরের মানুষ মনে হয়। ‘কেন মা–বাবা আমাকে বোঝে না?’, ‘আমি তো আর ছোট নেই’, ‘আমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে’, ‘ভাইয়াকে বন্ধুদের সঙ্গে বের হতে দিচ্ছে, আমাকে দিচ্ছে না’—অভিযোগের সুরে কিশোরীর মুখে এমন কথা শোনা যায়। মা–বাবা ছক্কা পেটানোর মতো করে এসব অনুযোগের লুজ বলগুলো ঝেঁটিয়ে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেন।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, বয়ঃসন্ধিতে ছেলে ও মেয়ে উভয়েই বেশি স্পর্শকাতর থাকে। সামাজিক কারণে মেয়েরা আরেকটু আড়ষ্ট থাকে। ফলে তাদের অভিযোগ, অনুযোগ এমনকি সাধারণ মন খারাপকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
আমি যেদিন বড় হব
খুব মন খারাপ হলে কিশোরী মন অস্থির হয়ে ওঠে। নিজেকে দিশেহারা লাগে। পড়ার ঘরের জানালার পাশে বসা ছোট্ট চড়ুই পাখির মতো মুক্তবিহঙ্গ হওয়ার স্বপ্ন দেখে। হলিউডের একটি সিনেমা থারটিন গোয়িং অন থার্টিতে সদ্য ১৩–তে পা দেওয়া মেয়েটির বড় হতে ইচ্ছে করে। ওই জীবনের রং স্বাদ কেমন, জানার অদম্য আগ্রহ থেকে জাদুকরিভাবে এক রাতে ১৩ থেকে ৩০ বছর বয়সে পৌঁছে যায় সে। সেখানে দেখানো হয়, ১৩ বছর বয়সেও যেমন ঝঞ্ঝা, ঝক্কি পোহাতে হয়। ৩০ বছর বয়সেও নেহাত ঝামেলা কম নয়। টিন ভোগ, সেভেনটিন ও আইএমডিবির করা টিনএজারদের পছন্দের সিনেমার তালিকায় এটি আছে।
শুধু বড় হলেই হবে না, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে দায়িত্ব নেওয়া শেখাতে হবে। নিজের ছোট ছোট দায়িত্ব নিলে একসময় ভাইবোন–পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবে। এতে করে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। জীবনে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা নিজেই সামলাতে পারবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেহজাবীন হক মনে করেন, মা–বাবার ভূমিকা এখানে সবচেয়ে বড়। মন চাইবে বড়দের মতো ব্যবহার করতে। শারীরিক গড়ন–গঠনেও পরিবর্তন আসে। রাসায়নিক নানা ক্রিয়া–বিক্রিয়া শরীরে চলতে থাকে। শরীর–মনই জানান দেয় বড় হওয়ার ইচ্ছা। মেহজাবীন হক তাঁর কৈশোরের যতকথা বইতে এগুলোর আদ্যোপান্ত লিখেছেন। নিজেকে ‘কুল’ ও বড় হয়েছি প্রমাণ করতে গিয়ে ভুল পথে পা পিছলে যায় অনেকের। এমন ট্রমা যেন কিশোরী মনটির কাছেও আসতে না পারে, সে জন্য তাকে আগেই সতর্ক করে দিতে হবে।
যত্নে থাকা
টিনএজ বয়সের মেয়েটির মনের যত্ন যেমন নিতে হবে, তার শরীরের যত্ন নেওয়াও সমানভাবে দরকার। পুষ্টিবিদের পরামর্শ হলো, তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো। বাড়ন্ত বয়সে সুষম খাদ্য খেলে উচ্চতা, ওজন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যথাযথ হবে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে জাঙ্ক ফুডের রাজ্যে পা দেবেই। সেখানে যেন হারিয়ে না যায়, সেই কথাটা তাকে গল্পচ্ছলে, বন্ধুর মতো করে বলতে হবে। এখন খেলে ভবিষ্যতে স্থূলতাসহ অন্য অনেক শারীরিক সমস্যায় তাকে পড়তে হতে পারে। অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার খেলে ব্রণ উঠতে পারে। কিশোরী মেয়েটির কাছে ব্রণ যেন পাহাড়সম সমস্যা হিসেবে না দাঁড়ায়। তাই বাইরে থেকে ফিরেই ফেসওয়াশ দিয়ে মুখটা ধুতে হবে। এই বয়সের জন্য উপযুক্ত একটা ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঝরনার উচ্ছল জলধারা
কিশোরীর খিলখিল হাসি, উচ্ছলতা প্রাকৃতিক ঝরনার জলধারার মতো। কোনো বাধ মানতে চায় না। এই বয়সের স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে, না থাকলেই বরং তা বেমানান। আবার কিশোরীর জন্য ওত পেতে আছে বিপদের নানা ফাঁদ। সেই ফাঁদে যাতে কিশোরীর উচ্ছলতা হারিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে তাকে তৈরি করে দিতে হবে।