এই ঈদে সিলেট ভ্রমণ

চা–বাগানের জীবন, মালিনীছড়া, সিলেট। ছবি: মোছাব্বের হোসেন।
চা–বাগানের জীবন, মালিনীছড়া, সিলেট। ছবি: মোছাব্বের হোসেন।

এবারের ইদের ছুটিটা চমৎকারভাবে পড়েছে। ৩ জুন ছুটি নিলে ৩১ মে থেকে আগামী ৮ জুন পর্যন্ত নয় দিনের একটি লম্বা ছুটি পাওয়া যাবে। চাকরিজীবনে এ ধরনের বড় ছুটি পাওয়া রীতিমতো স্বপ্নের ব্যাপার। এ রকম দীর্ঘ বন্ধে সবারই ইচ্ছে করে পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব বা ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে কোনো দিকে ঘুরতে যেতে। এ সময় ঘুরতে গেলে গরম ও বৃষ্টির বিষয়টি মনে রাখতে হবে। ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে সিলেট হতে পারে আপনার পছন্দের গন্তব্যগুলোর একটি।

বাংলাদেশের বর্ষার রানি বলা হয় সিলেটকে। বর্ষায় সিলেটের আকর্ষণ বেড়ে যায় বহুগুণে। চা–বাগান, বন, স্বচ্ছ পানির নদী, ঝরনা—সবকিছু মিলে সিলেট ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা। ভ্রমণপিয়াসিদের কাছে সিলেটের প্রথম আকর্ষণ চা–বাগান। বাংলাদেশের মোট ১৬৩টি চা–বাগানের মধ্যে ১৩৫টি রয়েছে বৃহত্তর সিলেটে। এর মধ্যে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদর উপজেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি চা–বাগান। উপমহাদেশের প্রাচীনতম চা–বাগানগুলোর অন্যতম মালিনীছড়া রয়েছে সিলেটে।

মালিনীছড়া চা–বাগান, সিলেট। ছবি: মোছাব্বের হোসেন।
মালিনীছড়া চা–বাগান, সিলেট। ছবি: মোছাব্বের হোসেন।

এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য চা–বাগান হলো মালিনীছড়া, লাক্কাতুরা, তারাপুর, দলদলি, খাদিম, বড়জান, আলী বাহার, হাবিবনগর, আহমদ টি এস্টেট, খান চা–বাগান, লালাখাল টি এস্টেট, শ্রীপুর চা–বাগান, মুলাগুল চা–বাগান ইত্যাদি। চা–বাগানে চা তোলার কাজ শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। চলবে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। কাজেই এ সময় গেলে আপনি চা তোলাও দেখার সুযোগ পাবেন। চা–বাগান ছাড়াও সিলেটে অনেক কিছু দেখার রয়েছে।

অনেক আগে থেকেই সিলেটের জাফলং ভ্রমণকারীদের জন্য পছন্দের একটি জায়গা। পিয়াইন নদের স্বচ্ছ পানি আর দূর থেকে মেঘালয়ের সব ঝরনা মিলে জাফলং সিলেটের অন্যতম সেরা পর্যটনকেন্দ্র। বর্ষায় জাফলংয়ের ঝরনাগুলোয় পানিপ্রবাহ থাকে। সিলেটের উত্তর–পূর্ব দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলংয়ের অবস্থান। বর্ষায় জাফলং হয়ে ওঠে রূপের রানি। ধূলিধূসরিত রুক্ষ পরিবেশ হয়ে সবুজ–সতেজ। জাফলংয়ের পাশেই রয়েছ বিছনাকান্দি। এটি বর্তমানে সিলেটের অন্যতম সেরা পর্যটন এলাকা। পান্থুমাই-বিছনাকান্দি ও লক্ষ্মণছড়া—এই তিন জায়গা এক নৌকা ভাড়া করে এক দিনে ঘুরে আসা সম্ভব। কারণ, এই তিন জায়গা একই এলাকায়। বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল। এটিও সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত। বর্ষায় রাতারগুল হয়ে ওঠে এক কথায় অপূর্ব। জাফলং, বিছনাকান্দি, লক্ষ্মণছড়া, রাতারগুল—সবই সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায়। কাজেই এই জায়গাগুলো একবারে ঘোরার পরিকল্পনা করুন।

বিছানাকান্দি। ছবি: আরাফাত হোসেন
বিছানাকান্দি। ছবি: আরাফাত হোসেন

বনের মধ্যে ট্রেকিং করতে চাইলে বেছে নিতে পারেন ঘন গাছপালায় পরিপূর্ণ খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান। অনেক প্রজাতির পাখি ছাড়াও অজগর রয়েছে এ বনে। এদের দেখা পাওয়া সহজ নয়। সিলেট শহরের মধ্যে রয়েছে সুরমা নদীর পাড়ে ঐতিহাসিক কিন ব্রিজ ও হজরত শাহজালাল (র.)–এর মাজার। সারা দেশের আবহাওয়া গরম থাকলেও সিলেটে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে আবহাওয়া সহনীয় থাকে।

বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল সারা বছর যাওয়ার মতো একটি গন্তব্য। এটি মৌলভীবাজার জেলার একটি উপজেলা। চোখজুড়ানো বিশাল বিশাল চা–বাগান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বাইক্কা বিল মিলে শ্রীমঙ্গলকে করে তুলেছে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা একটি গন্তব্য। আর আপনার যদি ট্রেকিং করার ইচ্ছা থাকে, তবে চলে যেতে পারেন কমলগঞ্জ উপজেলার রাজাকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের মধ্যে থাকা হামহাম ঝরনায়। বছরের এ সময়ে শ্রীমঙ্গলে বৃষ্টি হয় বলে তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকে।

বাংলাদেশেরে একেবারে উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলায় এর অবস্থান। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই জলাভূমি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অসংখ্য ঝরনার অবদানে তৈরি হয়েছে। সবুজ পর্বতের পটভূমিতে নীল জলের এ হাওরে রয়েছে হিজল, করচগাছসহ স্বাদু পানির বনভূমি। অনেক জায়গায় পানি এত স্বচ্ছ যে হাওরের তলদেশও দেখা যায়।

বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল। ছবি: আরাফাত হোসেন
বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল। ছবি: আরাফাত হোসেন

জুনের প্রথম সপ্তাহে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রামসার সাইটটিকে বেছে নিতে পারেন। বৃহত্তর সিলেটে বাংলাদেশের অন্য জেলাগুলোর চেয়ে আগে বৃষ্টি শুরু হয়। তাই এ সময় হাওরে ভালো পানি থাকার সম্ভাবনা থাকবে। তাহিরপুর থেকে নৌকা ভাড়া করে কয়েকটা দিন হাওরে কাটিয়ে দিতে পারেন। জাদুকাটা নদী, শহীদ সিরাজ লেক, হিজল-করচের বন, আর অসংখ্য পাখি দেখে সময়টা ভালোই কাটবে।

কীভাবে যাবেন
সিলেট ভ্রমণের জন্য ঠিকমতো পরিকল্পনা করতে হবে আপনাকে। কয়েকটি ভাগে ভাগ করে এই পরিকল্পনা করতে পারেন। প্রথমে সিলেটের দর্শনীয় জায়গাগুলোর জন্য সোজা সিলেটে চলে যান। এখানে থাকার জন্য অসংখ্য হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। নগরীর দরগাহ গেটের কাছে বাজেট হোটেল বেশি। বাস, বিমান, রেল—সব পথেই সিলেট যাওয়া যায়। আর খাওয়ার জন্য রয়েছে চমৎকার সব রেস্তোরাঁ। তবে সিলেটে ঘোরাঘুরির জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা ব্যবহার করা ভালো। কারণ, অনেক রাস্তায় অটোরিকশা ছাড়া যাওয়া কঠিন, আর গাড়ি ভাড়া করলে অনেক বেশি খরচ পড়ে যায়। সিলেট থেকে চলে যেতে পারেন শ্রীমঙ্গল। এখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মানের রিসোর্ট ও হোটেল। শহরে বাজেট হোটেলগুলোর পাশাপাশি তারকা হোটেলও পাবেন থাকার জন্য।

লাউছড়া জাতীয় উদ্যান। ছবি: আলবাব।
লাউছড়া জাতীয় উদ্যান। ছবি: আলবাব।

টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে হলে বাসে করে সুনামগঞ্জ যেতে হবে। সেখান থেকে লেগুনায় বা মোটরসাইকেলে চড়ে তাহিরপুর। তাহিরপুর থেকে নৌকা ভাড়া করে দুদিনের জন্য ঘুরে বেড়াতে পারেন হাওরে। খোলা হাওরে শরীরে রোদও লাগবে অনেক। তাই রোদের জন্য ছাতা, সানগ্লাস, ক্যাপ সঙ্গে রাখবেন। এ ছাড়া লাইফ জ্যাকেট রাখতে হবে, হাওরে যখন-তখন ঝড় উঠতে পারে। আর পানিনিরোধক ব্যাগও সঙ্গে রাখবেন।

যা করবেন
চা–বাগান ঘুরতে যাওয়ার আগে অবশ্যই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে নেবেন। বনে ঘুরতে গিয়ে অযথাই শব্দদূষণ করবেন না। এতে বন্যর প্রাণীরা বিরক্ত হয়। সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি বলে যখন-তখন বৃষ্টির মুখে পরতে পারেন। তাই ছাতা বা রেইনকোট সঙ্গে রাখুন।

প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওর। ছবি: সায়মন হোসেন।
প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওর। ছবি: সায়মন হোসেন।



বৃহত্তর সিলেটের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ
জাফলং, হজরত শাহজালাল (রা.) ও হজরত শাহ পরান (রা.)–এর মাজার শরিফ, জৈন্তাপুর, মাধবকুণ্ড ও পরীকুণ্ড জলপ্রপাত, শ্রীমঙ্গল, লালাখাল, তামাবিল, হাকালুকি হাওর, কিন ব্রিজ, ভোলাগঞ্জ, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের বাড়ি, হাছন রাজা জাদুঘর, মলিনীছড়া চা–বাগান, ড্রিমল্যান্ড পার্ক, আলী আমজাদের ঘড়ি, মণিপুরি রাজবাড়ি, মণিপুরি মিউজিয়াম, শাহি ঈদগাহ, ওসমানী শিশুপার্ক, হামহাম জলপ্রপাত, সাতছড়ি অভয়ারণ্য, রেমা উদ্যান, এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং, মির্জাপুর ইস্পাহানি চা–বাগান, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, শাহ আবদুল করিমের বাড়ি, সুনামগঞ্জ শহরে হাছন রাজা মিউজিয়াম।

লেখক: ভ্রমণবিষয়ক ফেসবুক গ্রুপের মডারেটর।