রোমান পুরাণের প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসের অন্যতম প্রতীক গোলাপ হলেও গোলাপ নির্যাস থেকে তৈরি সুগন্ধি তিনি ব্যবহার করতেন কি না, তা জানা যায় না। গ্রিক দেবী আফ্রোদিতিও কোন সুগন্ধি মেখে পৃথিবীতে প্রেম বিলাতেন, তারও উল্লেখ পাওয়া যায় না কোথাও। বেহুলা, মহুয়া, কঙ্কাবতীসহ আমাদের কিংবদন্তির নায়িকাদের সাজসজ্জার বিবরণ পাওয়া গেলেও তাঁরা কোন সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, তা জানার তেমন কোনো সুযোগ কোনো রসিক কবিরা করে দেননি।
কিন্তু মেরিলিন মনরো, এ যুগের ঐশ্বর্য রাই বচ্চনসহ সব সুন্দরীই যে দারুণ সব সুগন্ধি ব্যবহার করতেন বা করে থাকেন, সে বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল। তাঁদের জীবনযাপনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে যে সুগন্ধির উপস্থিতি রয়েছে, সেটা বলাই বাহুল্য। নারী কিংবা পুরুষ—সবার মধ্যে সুগন্ধি ব্যবহারের একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমরা শুনে থাকি, মোগল হেরেমের বৈচিত্র্যময় জীবনে সুগন্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রাজ নারী বা পুরুষদের পছন্দ ছিল একেক রকমের সুগন্ধি। এর পেছনে খরচও হতো বিস্তর। এমনও শোনা যায় যে নির্দিষ্ট সুগন্ধের জন্য বিস্তর অঞ্চল খুঁজে আনা হতো সুগন্ধির মূল উপকরণ। সুগন্ধি নিয়ে যুগে যুগে এই যে পাগলামি–মাতামাতি, এর কারণটা কী? এর একটাই হয়তো উত্তর—সুগন্ধির একটা আভিজাত্য আছে। খুব সহজেই এটি মানুষকে সতেজ, তরতাজা করে তুলতে পারে। কিংবা এর আরও অনেক কারণ আছে, যেটা আমরা এখনো জানি না।
লাতিন শব্দ ‘পারফিউমাস’ থেকে পারফিউম শব্দটির উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন লাতিন ভাষার মতোই সুগন্ধি ব্যবহারের ইতিহাস প্রাচীন। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ সালে সুগন্ধি ব্যবহারের ইতিহাস পাওয়া যায়। আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতাতেও সুগন্ধির উল্লেখ আছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন সভ্যতায় সুগন্ধি উৎপাদন ও ব্যবহারের ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে শরীরে ব্যবহারের উপযোগী সুগন্ধির উৎপত্তি কোথায় হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে বিস্তর।
মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক, কুয়েত ও সৌদি আরব অঞ্চল), প্রাচীন সিন্ধু অঞ্চল, প্রাচীন রোম, সাইপ্রাস—এসব অঞ্চলের নামই বেশি শোনা যায়। পশ্চিম ইউরোপে ১২২১ সালের দিকে ইতালিতে সুগন্ধির গল্প পাওয়া যায়। বিশ্বের প্রথম নারী রসায়নবিদ তাপ্পুতির নাম শোনা যায় সুগন্ধি–সম্পর্কিত ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্রে। তিনি ফুল, তেল ও গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে সুগন্ধি তৈরি করতেন। কিন্তু ২০০৩ সালে নৃতাত্ত্বিকদের একটি আবিষ্কার আগের সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে দেয়। এই আবিষ্কারের ফলে আমরা জানতে পারি, পৃথিবীর প্রাচীনতম সুগন্ধির সন্ধান পাওয়া গেছে সাইপ্রাস অঞ্চলে। কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে জানা গেছে, সেই সুগন্ধির বয়স আনুমানিক চার হাজার বছর। এই আবিষ্কারের ফলে সুগন্ধি নিয়ে আগের সব ধারণাকে নতুন করে সাজাতে হচ্ছে গবেষকদের।
সুগন্ধি বিষয়ে সর্বশেষ তথ্যের সূত্র ধরে বলা যায় যে এটি কোনো একক অঞ্চলে পরিপুষ্টি লাভ করেনি। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে নবম শতক, তেরো শতক, সতেরো শতকে বিভিন্ন দেশের রসায়নবিদদের লিখিত বিভিন্ন বইয়ে সুগন্ধি তৈরির বিভিন্ন পদ্ধতির কথা জানা যায়। এ থেকে মনে করা যায় যে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সুগন্ধি তৈরির স্থানীয় পদ্ধতি গড়ে ওঠে। এর বড় উদাহরণ, ১৩৭০ সালে একজন হাঙ্গেরীয় সুগন্ধি তেলের সঙ্গে অ্যালকোহলের মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেছিলেন নতুন ধরনের সুগন্ধি। সম্ভবত এই পদ্ধতিই পরে ‘আধুনিক সুগন্ধি’ তৈরির পথ খুলে দেয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্নভাবে—বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের হাত ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে সুগন্ধি তৈরির একটা সাধারণ ধারা গড়ে ওঠে এবং তাতে নতুন নতুন স্থানীয় উপাদান যুক্ত হতে থাকে। পৃথিবীর কোন অঞ্চলে সুগন্ধির উৎপত্তি হয়েছে, সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও একটি বিষয়ে বিতর্ক নেই, আর তা হচ্ছে সুগন্ধি তৈরির মূল উপাদান।
সাইপ্রাসে সন্ধান পাওয়া পৃথিবীর প্রাচীনতম সুগন্ধি কারখানাতেও দেখা যাচ্ছে ফল ও ফুল ব্যবহার করা হতো সুঘ্রাণ তৈরিতে। মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে কিংবা প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতাতেও সুগন্ধি তৈরির যে উপকরণের হদিস পাওয়া যায় তা–ও সেই ফুল, ফল আর গাছের বিভিন্ন অংশ। কখনো কখনো উদ্ভিদ থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা তেল।
যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় যে সুগন্ধি এখনকার মতো অতীতেও বোতলবন্দীই ছিল, অভিজাত সমাজে পুরুষ ও নারী উভয়েই ব্যবহার করতেন। তবে সাধারণ মানুষের কাছে সুগন্ধি এখনকার মতো অতীতেও ছিল দুর্মূল্যের।
অতীত ছেড়ে আসুন এবার একটু বর্তমানে ফেরা যাক। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি পাওয়া যায় এখন হাতের নাগালেই। বিভিন্ন ব্র্যান্ড অনুসারে এসবের দামেরও তারতম্য রয়েছে। শুধু দাম দিয়ে কিনলেই চলবে না, সুগন্ধি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উত্তম তরিকা জানতে হবে। সুগন্ধি যেহেতু মানুষের মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, তাই রাত ও দিন—এই দুই সময়ের জন্য নির্দিষ্ট সুগন্ধি রয়েছে। তবে সব সময় যে সুগন্ধির বোতল বা প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকবে রাত বা দিন, তেমন না–ও হতে পারে। বরং সুগন্ধির প্যাকেজিং এবং প্যাকেটের রং দেখে আপনাকে বুঝে নিতে হবে কখন কোন সুগন্ধি ব্যবহার করবেন আপনি।
আমাদের ব্যবহার্য বিলাসদ্রব্যের মধ্যে সম্ভবত এই সুগন্ধির ক্ষেত্রে অতীতে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘পছন্দ-অপছন্দ, পোশাক, জীবনযাপন থেকেই বোঝা যায় কার কেমন সুগন্ধি ভালো লাগতে পারে। উল্টো দিকে আপনি কোন ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করছেন, তাতে আপনার ব্যক্তিত্ব কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা উল্লেখ করেন, উডি ঘরানার সুগন্ধি যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁরা প্রকৃতি ও গাছ ভালোবাসেন।… অন্যদিকে রোমান্টিক ও নমনীয় মনের অধিকারীরা ফুলের মতো ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধি পছন্দ করেন। তাঁরা রুচিকর পোশাক ও সাজ পছন্দ করেন। ঋজু ব্যক্তিত্বের নারীদের পছন্দ প্রাচ্য (ওরিয়েন্টাল) ঘরানার সুগন্ধি।… উচ্ছল, প্রাণশক্তিতে ভরপুর তারুণ্যের জন্য ফলের নির্যাস। নিরুদ্বেগ থাকতে পছন্দ করেন এমন ব্যক্তিত্বের মানুষেরাও পছন্দ করেন গ্রিন পারফিউম।’ (সূত্র: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো নকশা)।
বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি পাওয়া যায় বাজারে। তবে বুঝতে হবে কোন সুগন্ধি আপনার জন্য প্রযোজ্য বা আপনি কোন ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করতে চান। পারফিউম, ও ডি পারফিউম, ও ডি টয়লেট, ও ডি কোলন ইত্যাদি লেখা দেখা যায় সুগন্ধির বোতলে।
মানুষের পছন্দ–অপছন্দ নানা রকম। তাই গ্রাহকের চাহিদা বুঝে নানা ধরনের সুগন্ধি পাওয়া যায় বাজারে। তবে বুঝতে হবে কোন সুগন্ধি আপনার জন্য প্রযোজ্য বা আপনি কোন ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করতে চান। পারফিউম, ও ডি পারফিউম, ও ডি টয়লেট, ও ডি কোলন ইত্যাদি লেখা দেখা যায় সুগন্ধির বোতলে।
পারফিউম লেখা বোতলগুলোয় সাধারণত ১৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সুগন্ধ থাকে এবং এই সুগন্ধ ছয় থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত আপনাকে সতেজ রাখতে পারবে। যেসব বোতলের গায়ে ‘ও ডি পারফিউম’ লেখা থাকে, সেগুলো ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সুগন্ধ বহন করে থাকে। ও ডি পারফিউম লেখা এই সুগন্ধি আপনাকে ৪-৫ ঘণ্টা স্নিগ্ধ রাখবে। এই শ্রেণির সুগন্ধি প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য আদর্শ। এটিও স্পর্শকাতর ত্বকের জন্য ভালো। যেসব সুগন্ধির বোতলের গায়ে ‘ও ডি টয়লেট’ লেখা থাকে, সেগুলোতে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘনত্বের সুগন্ধ পাওয়া যাবে। দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় সুগন্ধির জগতে এর চাহিদাও বেশি। এই শ্রেণির সুগন্ধি সাধারণত দিনের বেলা বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ২ থেকে ৩ ঘণ্টা স্থায়ী হয়ে থাকে এর সুগন্ধ। বোতলের গায়ে ‘ও ডি কোলন’ এবং ‘ও ডি ফ্রেশ’ লেখা সুগন্ধিও রয়েছে বাজারে। ও ডি কোলন লেখা সুগন্ধিতে ২ থেকে ৪ শতাংশ ঘনত্বের সুগন্ধি থাকে। আর ‘ও ডি ফ্রেশ’ লেখা সুগন্ধি হলো সবচেয়ে কম ঘনত্বের সুগন্ধি। এর ঘনত্ব ১ থেকে ৩ শতাংশ। (সূত্র: প্রথম আলো, নকশা)।
প্রসাধন হিসেবে অত্যন্ত প্রাচীন সামগ্রী হলো সুগন্ধি। আভিজাত্য আর রুচির এক অপূর্ব মেলবন্ধন তৈরি হয় সুগন্ধির ব্যবহারে। তাই বুঝেশুনে সঠিক সুগন্ধি ব্যবহার করা উচিত। সঠিক সময়ে সঠিক সুগন্ধির ব্যবহার আপনার ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্যকে নিয়ে যেতে পারে এক অনন্য উচ্চতায়।