‘অতনু, তুমি ঝাল খেয়ো না। ঝাল খাওয়া আমি পছন্দ করি না।’ বলে উঠলেন অতনুর মা। অতনু কিন্তু ঝাল খেতে পছন্দ করে।
আবার সুমিতের বাবার পছন্দ ক্রিকেট খেলা দেখা। সুমিত কিন্তু ফুটবলের ভক্ত। ওর বাবা জোর করে সুমিতকে ক্রিকেট খেলা দেখাবেনই; আর বলবেন, ‘ক্রিকেটের মতো খেলা আর আছে নাকি, কিসের ফুটবল খেলা দেখিস। ফুটবল–টুটবল বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখ, ক্রিকেট খেল।’
এভাবে অনেক মা–বাবা নিজের ইচ্ছা–অনিচ্ছা, ভালো লাগা–মন্দ লাগা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি শিশুই নিজের চারপাশ থেকে বেড়ে ওঠার উপকরণ গ্রহণ করে। আশপাশের মানুষ, পরিবেশ, রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ তার মনঃসামাজিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শিশু যা দেখে, যা অনুভব করে, সেটি থেকেই তার ‘স্বাদ’ তৈরি হয়। এই স্বাদ কেবল খাবারের বিষয়ে নয়; বরং উপভোগ্য সব বিষয় নিয়ে তার মধ্যে নিজস্ব ভালো লাগার অভিজ্ঞতা তৈরি হয়, যেটাকে বলা যায় শিশুর অনন্য পছন্দ বা ‘ইউনিক টেস্ট’। দেখা যায়, একটি শিশু সবুজ রং ভালোবাসে, আরেকটি শিশু ভালোবাসে হলুদ। দুজনের মা–বাবার পছন্দ নীল রং। এখন মা–বাবা যদি শিশুর পছন্দের ওপর নিজেদের পছন্দকে চাপিয়ে দিয়ে ওই সবুজ আর হলুদের বদলে নীল রংকে শিশুদের জোর করে পছন্দ করাতে চান, তাহলে শিশুর ‘পারসেপচুয়াল ডেভেলপমেন্ট’ বা ‘ধারণার বিকাশ’ বাধাগ্রস্ত হয়, নিজের মতো করে সে ভাবতে পারে না, নিজের পছন্দ অপছন্দ তৈরি হয় না, আবার কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সৃষ্টি হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, মা–বাবা যদি নিজের পছন্দ–অপছন্দ শিশুর ওপর চাপিয়ে দিতে চান, তাহলে শিশুর আচরণ অবাধ্য হয়ে ওঠে, মা–বাবার যৌক্তিক আর অতি প্রয়োজনীয় উপদেশও তখন তারা শুনতে চায় না।
প্রতিটি শিশুর মনঃসামাজিক বিকাশের ধারার অন্যতম হচ্ছে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে, নিজস্বতা হিসেবে সে বেড়ে ওঠে। আর এই বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়েই সুগঠিত হয় তার ব্যক্তিত্ব। শিশুকে নিজের মতো করে বড় হতে না দিলে ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পরিণত বয়সে তার অন্যের সঙ্গে মানিয়ে চলতে, স্বাভাবিক আচরণ করতে বেগ পেতে হয়।
অনেক সময় মা–বাবা মনে করেন, ‘আমি তো আমার সন্তানের ভালোর জন্যই তার অভ্যাস পরিবর্তন করতে চাইছি।’ এখানে দুটো বিষয় মাথায় রাখতে হবে—১. যে অভ্যাসগুলো সত্যিই তার ভালোর জন্য, সেগুলো তো অবশ্যই পালন করতে হবে এবং ক্ষতিকর অভ্যাস দূর করার জন্য চেষ্টা করতেই হবে—যেমন: সময় মতো ঘুমানো, দাঁত পরিষ্কার করা, গোসল করা, ফাস্ট ফুড না খাওয়া, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার না করা ইত্যাদি। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে যে অভ্যাসগুলো মোটেই ক্ষতিকর নয়, যা শিশুর একান্ত নিজস্ব পছন্দ–অপছন্দ, সেগুলোয় যদি তার কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি না হয়, তবে জোর করে সেগুলো পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। যেমন: শিশুর স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, পছন্দের ফ্যাশন (যদি সেটা পরিবার আর সমাজের বিপরীতে না হয়), পছন্দের খেলা ইত্যাদি। এগুলো পরিবর্তনের জন্য শিশুকে চাপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
শিশুর যে স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য, তার ভালো লাগা-মন্দ লাগা, এগুলো নিয়েই শিশুকে বেড়ে উঠতে দিন। এ জন্য বাবা-মায়েরা যা করবেন, তা হলো শিশুর পছন্দ–অপছন্দকে সম্মান করুন, শিশুর কোনো অভ্যাস যদি তার কোনো ক্ষতির কারণ না হয়, তবে সেটা বদলাবেন না, শিশুর স্বাদ অনুযায়ী তাকে খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করুন (যদি না সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়), শিশুর পছন্দে খেলাকে নিরুৎসাহিত করে আপনার পছন্দ তার ওপরে চাপিয়ে দেবেন না। মা-বাবা সব সময় তাঁর নিজের সন্তানের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে চান, এটা শিশুর স্বকীয়তাকে ঢেকে দিতে পারে। শিশুর স্বভাবজাত নিজস্বতাকে ফুটিয়ে তুলতে, শিশুর সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে শিশুর নিজের পছন্দটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন।
আহমেদ হেলাল
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।