বর্ষা অনেকের প্রিয় ঋতু হলেও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দিক থেকে শরৎই অনন্য। বর্ষার বৃষ্টিমুখর অনুজ্জ্বল দিনের পর শরতের মেঘের মতো আমাদের মনও যেন হালকা হয়ে যায়। শরতের আকাশ, নদী, ফুল—সবই শান্ত, মায়াময়। ভাদ্র-আশ্বিনের এই শুভ্র রূপ পবিত্রতার প্রতীক। বিলের শাপলা, নদীতীরের কাশ ফুল, আঙিনার শিউলি—সবই কোমল, পবিত্র। যখন শিশিরের শব্দের মতো টুপটাপ শিউলি ঝরে, তখন অনুভবে শরৎ আসে। কাশবনে দল বেঁধে আসে চড়ুই পাখিরা। নদী শান্ত হয়ে আসে। তখন থাকে না দুকূল ছাপানো বিপুল জলরাশির উত্তাল ঢেউ। আর শরতের নদী মানেই দুই পাড়ে কাশবনের ছোট ছোট রুপালি ঢেউ। শরতের এই স্নিগ্ধ শোভাকে আরও মোহময় করে এ মৌসুমের বিচিত্র ফুল। নদী কিংবা জলার ধারে ফোটে কাশ-কুশ, ঘরের আঙিনায় ফোটে শিউলি বা শেফালি, খাল-বিল-পুকুর-ডোবায় থাকে অসংখ্য জলজ ফুল। আর শেষরাতের মৃদু কুয়াশায় ঢেকে থাকা মায়াবী ফুলগুলো যেন আরও রূপসী হয়ে ওঠে। শিশিরভেজা শিউলি, বাতাসে মৃদু দোল খাওয়া কাশবনের মঞ্জরি, পদ্ম-শাপলা-শালুকে আচ্ছন্ন জলাভূমি শরতের চিরকালীন রূপ।
শরৎ মানেই শিউলি ফোটার দিন। শিউলির মধুগন্ধ ভেসে বেড়ানোর দিন। শিউলি বা শেফালি যা-ই বলি না কেন, চমৎকার এ ফুল নিয়ে দুটি গ্রিক ও ভারতীয় উপকথা আছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসে শিউলির বিশাল বন ও তীব্র ঘ্রাণের কথা বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আরণ্যক–এ শরতের অন্যতম অনুষঙ্গ কাশ ফুলের প্রসঙ্গও এসেছে শৈল্পিকভাবে। রবীন্দ্রনাথ গান ও কবিতায় নানাভাবে, নানা প্রসঙ্গে অন্তত একুশ বার শিউলির কথা বলেছেন।
শরতের রাত শিউলির গন্ধে ভরপুর। সূর্যের সঙ্গে ওদের আড়ি, তাই নিশিভোরেই ঝরে পড়ে মাটিতে। ফুলের পাপড়িরা গন্ধ বিলায়, শিউলি ফুলের বোঁটার হলুদ রং টিকে থাকে অনেক দিন। শিউলির মালা দিয়ে ঘর সাজানো যায়। আবার শিউলি ফুলের মালা খোঁপায়ও পরা যায়। প্রাচীনকালে বোঁটার রং পায়েস বা মিষ্টান্নে ব্যবহার করা হতো। হিন্দুদের পূজার উপকরণ হিসেবেও শিউলি ফুলের অনেক কদর।
কাশ শরতের অনন্য ফুল। শরতে কাশবনের স্নিগ্ধ শোভা প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত রাখে। শ্রাবণ শেষে সাদা সাদা তুলোর মতো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ, মাঝেমধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়ে সেই মেঘ আরও হালকা হয়, আরও সাদা হয়। সে মেঘের ছায়া পড়ে নদীর ধারে, কাশবনে। মেঘ, আকাশ আর কাশ ফুলের ছায়া পড়ে নদীর নীল জলে। এমন মনোলোভা চিত্র কী আর সব সময় দেখা যায়?
শরৎ উৎসবের ঋতু। শারদ পূজার প্রধান উপকরণ পদ্ম ফোটে শরতে। কোথাও কোথাও বড় আকারের শতদল পদ্মও আছে। ইদানীং শ্বেতপদ্ম বেশ দুর্লভ হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিকভাবে খুব কম স্থানেই বেঁচে আছে ফুলটি। পদ্ম আমাদের জলাভূমির রানি। চর্যাপদে অসংখ্য বার পদ্মের কথা এসেছে। নানাভাবে পদ্মের সৌন্দর্য বিবৃত হয়েছে।
জলজ ফুল মাখনাও শরতেই বেশি দেখা যায়। শরতের মাঝামাঝি সময় থেকেই স্থলপদ্ম ফুটতে শুরু করে। শরতের সকালে সূর্যের প্রথম আলোয় অপরূপ হয়ে ওঠে স্থলপদ্ম। এমন দিনেই নতুন রং আর রূপের পসরা সাজিয়ে বসে ধাইরা ফুল। সাধারণত পুরোনো বৃক্ষগুলোতেই পরজীবী এই ফুলের শোভা উপভোগ করা যায়। এ সময় দই গোটার ফুলগুলোও ফুটতে শুরু করে। শরতের শেষভাগে ফোটে চা-ফুল। চা-বাগানের অনুচ্চ টিলাগুলোয় খইয়ের মতো শুভ্রতা ছড়ায় এ ফুল। আর চা-বাগানের ছায়াবৃক্ষের মেডলাগাছেও শরতেই ফুল আসতে শুরু করে। সাদাটে এই ফুল এখন নগর উদ্যানেও দেখা যায়।
ডোল কলমি সারা বছর কমবেশি ফুটলেও শরৎকালেই বেশি দেখা যায় এই ফুল। আমাদের পথের ধারে, ঝোপ-জঙ্গলের পাশে সহজেই চোখে পড়ে। সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ও বলিভিয়ার পাহাড়ি এলাকার ফুল। পর্তুগিজ ধর্মযাজকেরা ভারতে নিয়ে আসেন গির্জার বাগানের সৌন্দর্য বাড়াতে। তারপর ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে।
শরতের স্তব্ধতা ঘুমপাড়ানি গানের মতো শান্ত, মধুর। নদীতে পালতোলা নৌকা, আকাশে ছেঁড়াখোঁড়া ভাসমান মেঘ। নীল আকাশ আর নদীর নীল জলের পটভূমিতে সাদা কাশ ফুলের মেলায় মনটা কেমন উদাস হয়ে ওঠে। আর এমন একটি নান্দনিক দৃশ্য দেখার জন্য সব সময়ই অপেক্ষায় থাকে আমাদের মন।